
মোঃ মশিউর রহমান বিপুলঃ
আজ ১ ডিসেম্বর, বীরপ্রতীক তারামন বিবির সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের এই দিনে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলা সদরের কাচারীপাড়ায় নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অন্যতম সাহসী এই নারী যোদ্ধা। শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহজনিত দীর্ঘদিনের জটিলতায় ভুগে ৬১ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে তার বাড়িতেই দাফন করা হয়।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখে যাওয়া তারামন বিবি মৃত্যুর বহু বছর আগেই পেয়েছিলেন ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব; কিন্তু দারিদ্র্য, বিচ্ছিন্ন জনপদে বসবাস ও আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ না থাকায় দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি জানতেই পারেননি তার প্রাপ্য সম্মাননার কথা। ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে বীরপ্রতীক খেতাব তুলে দেন। দেশের ইতিহাসে যেসব নারী যোদ্ধা এই সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন—তারামন বিবি ছিলেন তাদের অন্যতম।
১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেন তারামন বিবি। সাত ভাই–বোনের মধ্যে তৃতীয় তিনি। অভাবগ্রস্ত শৈশব-কৈশোরে লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন। ঠিক সেই সময়েই, মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে, ১৯৭১ সালে তার জীবনে আসে জীবন বদলে দেওয়া মুহূর্ত—মুক্তিযুদ্ধে যোগদান।
প্রথমদিকে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে রান্না করা, খাবার সরবরাহ, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা এবং পাকিস্তানি হানাদারদের খবর সংগ্রহের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। ধীরে ধীরে রান্নার খুন্তির সঙ্গে রাইফেলও হাতে তুলে নেন। প্রশিক্ষণের পর সম্মুখসমরে অংশ নেন সাহসিকতার সঙ্গে। কিশোরী বয়সেই সত্যিকারের যোদ্ধায় রূপ নেন এই নারী। ১৯৭৩ সালে তার বীরত্বগাঁথা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায় ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবের মাধ্যমে।
তবে দারিদ্র্য আর প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের জীবন তাকে দীর্ঘদিন আড়ালে রেখেছিল। অবশেষে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের অধ্যাপক ও গবেষক বিমল কান্তি দে এবং কুড়িগ্রামের অধ্যাপক আবদুস সবুর ফারুকীর নিরলস খোঁজে ১৯৯৫ সালে তার পরিচয় নতুন করে উন্মোচিত হয়। এরপর তাকে ঢাকায় এনে রাষ্ট্র, সমাজ ও গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরা হয়। তার জীবনসংগ্রাম ও বীরত্বের গল্প নিয়ে সাংবাদিক ও লেখক আনিসুল হক রচনা করেন ‘বীর প্রতীকের খোঁজে’ বই। তার জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয় নাটক ‘করিমন বেওয়া’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রও।
তারামন বিবি আজ শুধু কুড়িগ্রাম নয়—দেশের সর্বস্তরে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণীয়। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে কুড়িগ্রাম, রাজিবপুর এবং ঢাকা সহ বিভিন্ন স্থানে দোয়া, আলোচনা সভা, প্রদীপ প্রজ্বালন ও স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসে তারামন বিবি এক অনন্য বীরকন্যা—যিনি হৃদয়ে দেশপ্রেম, হাতে অস্ত্র এবং অদম্য সাহস নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে নিজের নাম অমর করে গেছেন। তার জীবনগাথা আজও অনুপ্রেরণা দেয় দেশের তরুণ প্রজন্মকে—দেশের প্রতি ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও ন্যায়ের পথের অটল অবস্থান শেখায়।
