Monday, May 20, 2024
HomeScrollingমাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে বসে

মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে বসে

একটা সময় গোলার ধান আর পুকুরের মাছ সহজলভ্য ছিল প্রতিটি বাঙালির কাছে। নব্বইয়ের দশকেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা এজন্যই বলা হতো। কিন্তু একবিংশ শতাব্দিতে এসে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে বসে। পুকুর-নদী-জলাশয় থেকে বিলীন হতে শুরু করল দেশীয় প্রজাতির মাছ। এখন ভরা বর্ষাতেও মিলছে না সহজলভ্য পুষ্টির অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসা এসব মাছ। ফলে পাত থেকে দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ অনেকটা উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

নব্বইয়ের দশকেও নদী-খাল-বিলে প্রচুর দেশীয় মাছ ধরা পড়ত। বিশেষ করে বর্ষাকালে এসব মাছের অভাব ছিল না। খাল-বিলে ধরা পড়ত অসংখ্য কৈ, মাগুর, শিং, টাকি, টেংরা, পুঁটি, মলা, ঢেলা, বাইম, পয়া, শোল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বুড়াল, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, মালান্দা, গজার, চিতল, পোয়া, বালিয়া, কাকিলা, গজারসহ নানা প্রজাতির মাছ। পৌষ-মাঘে পুকুর, খাল, ডোবা, হাওর-বাঁওড়ে পানি কমতে থাকলে মাছ ধরার ধুম পড়ত। কখনও পানি সেচে, আবার কখনও বিভিন্ন জাল পেতে ধরা পড়া এসব মাছে বাঙালি রসনা তৃপ্ত করত। শুধু জেলেরাই নয়, উৎসব করে মাছ ধরত গ্রামের নানা শ্রেণিপেশার মানুষও। বাড়িতে খাওয়ার পাশাপাশি বিক্রিও করা হতো এসব মাছ। অনেক কম দামে পাওয়া যেত দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ।

চাষের মাছের ভিড়ে বর্ষা মৌসুমে সামান্য কিছু দেশি মাছ পাওয়া গেলেও দাম হাতের নাগালের বাইরে। এক দশক আগেও যে টাকি মাছ বিক্রি হত ৪০ টাকা কেজি দরে, এখন সেই মাছ ৪০০ টাকা কেজিতেও পাওয়া দুস্কর। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল সবখানেই একই চিত্র।

কিন্তু এখন বাজারে দেশীয় মাছ অনেকটা দুর্লভ হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাজার ঘুরে পাওয়া যায় না দেশি মাছ। মাঝে মাঝে পাওয়া গেলেও দাম অনেক চড়া।

দেশি মাছের বদলে এখন বাজারে জায়গা দখল করে নিয়েছে চাষের পাঙ্গাশ, কৈ, শিং, মাগুর, পাবদা, ট্যাংরা, তেলাপিয়া, ক্রস ও কার্পজাতীয় মাছ। যারা একসময় পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, তাদেরকে এখন বাজার থেকে চাষের মাছ কিনে খেতে হচ্ছে। নদীতে পানি না থাকায় আর খাল-বিল লিজ দেওয়ায় অনেক মৎস্যজীবীও বদলে ফেলেছেন তাদের পেশা।

চাষের মাছের ভিড়ে বর্ষা মৌসুমে সামান্য কিছু দেশি মাছ পাওয়া গেলেও দাম হাতের নাগালের বাইরে। এক দশক আগেও যে টাকি মাছ বিক্রি হত ৪০ টাকা কেজি দরে, এখন সেই মাছ ৪০০ টাকা কেজিতেও পাওয়া দুস্কর। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল সবখানেই একই চিত্র।

গত শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সবখানে চাষের মাছের অধিক্য বেশি। দুই-চারজন বিক্রেতা দেশীয় প্রজাতির মাছ বিক্রি করলেও তার পরিমাণ খুবই অল্প। এর মধ্যে টেংরা মাছ প্রতি কেজি ৮০০-১০০০ টাকা, শিং মাছ ৮০০-৯০০ টাকা, টাকি মাছ ৪০০-৫০০ টাকা, বাইম মাছ ৭০০-৮০০ টাকা, বালিয়া মাছ ৬০০-৭০০ টাকা, পুঁটি মাছ ৩০০-৪০০ টাকা, কয়েক প্রজাতির বিভিন্ন মাছ ৭০০-৮০০ টাকা কেজি দাম চাওয়া হচ্ছে। অথচ এক দশক আগেও এসব মাছ সর্বোচ্চ ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছিল।

গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারগুলোতেও দেশীয় মাছের দাম অনেক চড়া। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে এসব মাছ।

উত্তরের জেলা দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে উঠা শাহিনুর ঢাকা মেইলকে বলেন, ২০০২-২০০৩ সালের দিকে আমরা তখন ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি। বার্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে কত মাছ ধরেছি, আগে প্রতি বছরই বৃষ্টি হলে খাল বিল ডুবে যেত, তখন জাল দিয়ে মাছ ধরতাম। আবার বর্ষা চলে গেছে ধান ক্ষেতের আইলে নানা উপায়ে মাছ ধরতাম। শীতকালে পানি কমতে থাকলে খাল-বিল সেচে মাছ ধরেছি। এখন সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে খারাপ লাগে। কোথায় হারিয়ে গেল সেই দিনগুলো।

শাহিনুর বলেন, এখন বাজার ঘুরেও দেশি মাছ পাওয়া যায় না। মাঝেমধ্যে পাওয়া গেলেও অনেক দামের কারণে সাধারণ মানুষ কিনতে পারেন না।

পার্শ্ববর্তী কাহারোল উপজেলার সাইফুল আলম বলেন, ‘আমরা কিশোর বয়সে আনন্দ করে যে মাছ ধরেছি এখনকার ছেলেমেয়েরা এসব মা দেখা তো দূরের কথা, নামই শুনেনি। টাকি মাছ, শৌল মাছ, কৈ মাছ, শিং মাছ, পুঁটি মাছ। এখন আর সেই মাছ ধরার ঐতিহ্য নাই। পানিতেও মাছ নেই। বাজারে কিছু মাছ পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। ২০০৫ সালের দিকে গ্রামের বাজারগুলোতে টাকি মাছের কেজি ছিল ২০-৩০ টাকা। ডারিকা মাছের কেজি ছিল ২০ টাকা। কৈ মাছ, শিং মাছ ৪০-৫০ টাকা। এখন বাজারে এসব দেশি মাছ দেখাই যায় না। পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। ৭০০-৮০০র নিচে এসব মাছ নাই।

কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজের হোসাইন ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে জলাধারগুলোতে আগের মতো মাছ না পাওয়া যাওয়ার কারণে প্রান্তিক মানুষের যে আমিষের চাহিদা সেটি পূরণ হচ্ছে না। তবে এখনও হাওরাঞ্চসহ বিভিন্ন জায়গায় যতটুকু মাছ পাওয়া যাচ্ছে তার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না জেলেরা। আবার কয়েক হাত বদলে তা ঢাকায় এসে দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বী। এতে জেলেদেরও লাভ হচ্ছে না, আবার ভোক্তারাও সুফল পাচ্ছে না। সরকার ধান চালের মতো মাছের মধ্যে একটা সমন্বয় সিস্টেম চালু করলে জেলেরাও ন্যায্য দাম পাবে, ভোক্তারাও উপকৃত হবে।

যেসব কারণে হারাচ্ছে দেশীয় মাছ

জলাশয় থেকে দেশীয় মাছ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলি জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদীসংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা-পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ ও মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানোর কারণে দেশীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। এসব কারণে ৫০টিরও বেশি দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে বলে মনে করছেন তারা।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের প্রফেসর ড. কাজী আহসান হাবিব ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশীয় প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট হওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে পানি কমে গেছে। এতে অনেক নদীনালা শুকিয়ে গেছে। ফলে মাছের উৎপাদন কমে গেছে। পানি কমায় নদ-নদীগুলোতে বড় বড় চর তৈরি হয়েছে। ফলে মাছের উৎপাদন কমে গেছে। এছাড়াও আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে দূষণ। ঢাকার বুড়িগঙ্গার যে অবস্থা, এসব পানি ধীরে ধীরে অনেক জায়গায় চলে যাচ্ছে। এছাড়াও কলকারখানার দূষণসহ বিভিন্ন দূষণের কারণে মাছের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশকের ব্যবহার। যেসব এলাকায় নদী নাই, কিন্তু খাল-বিলে মাছ পাওয়া যেত সেসব এলাকায় কীটনাশক ব্যবহারের কারণে এসব এলাকায় দেশীয় মাছ উৎপাদন হচ্ছে না।

দেশীয় মাছ হারিয়ে যাওয়ার পেছনের জলবায়ু পরিবর্তনকেও অনেকটা দায়ী বলে মনে করছেন স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।

ঢাকা মেইলকে অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ‘দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের একটা বড় ইমপ্যাক্ট আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরা ও তাপমাত্রা বেড়েছে। জলাশয় কমে যাওয়ায় মাছ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ঘনঘন জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোনে মিঠা পানিতে লবণ পানি প্রবেশও অন্যতম দায়ী। কারণ, যেখানে লবণ পানি একবার প্রবেশ করে সেখানে আমাদের দেশীয় প্রজাতির মাছ আর টিকতে পারে না। এ কারণে আমাদের মৎস্য সেক্টরে ক্ষতি হচ্ছে।

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments