নির্বাচনী জোট নিয়ে এবার জটিল সমীকরণের মুখে পড়েছে টানা তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। একদিকে ১৪ দলীয় জোট, অপর দিকে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি। ১৪ দলের সঙ্গে আসন বণ্টন কীভাবে হবে, তা নিয়ে চলছে দফায় দফায় আলোচনা। আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে এখনো কিছুই পরিষ্কার না। তবে অভ্যন্তরীণভাবে জানা গেছে, জোটের শরিকরা আসন চান বেশি। আওয়ামী লীগ দিতে চায় কম। অপর দিকে জাতীয় পার্টির সঙ্গেও চলছে দেন-দরবার।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাষ্য- নির্বাচনে দাঁড়ালে হেরে আসবে এমন প্রার্থীকে আসন ছাড়তে চায় না আওয়ামী লীগ। প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা আছে, নির্বাচনে জয়ী হবে, কেবল এমন প্রার্থীকেই আসন দিতে চায় ক্ষমতাসীনরা।
এ বিষয়ে দ্বিমত আছে জোটের শরিকদের। ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইতিহাস কী বলে? আওয়ামী লীগ সেসব প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, তারা সবাই কি বিজয় লাভ করে?’
ইনু বলেন, ‘খোদ ওবায়দুল কাদের ২০০১ সালের ভোটে হেরে গিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে কি তাকে মনোনয়ন দেয়নি? জোটের প্রার্থী যদি নির্বাচনী ইতিহাসে পরাজিত হয়ে থাকে, জোটে কেন জিতবে না?’
আসন বণ্টন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের চাহিদা আমরা বলেছি, গতবারের চাইতে বাড়িয়ে দিন। এখন পর্যন্ত পুরোটাই আলোচনার পর্যায়ে আছে৷ আমরা আশা করছি, ১৫ তারিখের ভেতরে এটা নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।’
১৪ দলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘেঁষতে চায় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দেশজুড়ে প্রার্থিতা ঘোষণা করলেও দলটি সুনির্দিষ্ট আসনে বিজয় চূড়ান্ত করতে চায়। জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি এবার নির্বাচনে যাচ্ছে। তবে দলটি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি না এটা নিয়ে খোদ সরকারি দলে রয়েছে সংশয়। জাতীয় পার্টির একটি অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চায় জোটে৷ একাদশ জাতীয় সংসদে ২৬টি আসন পাওয়া জাতীয় পার্টি এবার আসন চায় অন্তত ৪০টি। বিষয়টি নিয়ে দেন দরবার চলছে৷ শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) এ বিষয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের৷ জাতীয় পার্টির অবস্থান নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের তারাতো বলেছে, তারা নির্বাচনে আছে, জোটে থাকতে চায়। তারা তো সরে যাবে বলেনি। সরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে, এটা নিয়ে আমরা আরও নিশ্চিত হতে চাই। ১৭/১৮ তারিখ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করি। অস্বস্তির কিছু নেই। এটাও আমাদের আরেকটা নতুন অভিজ্ঞতা।’
জোট প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘জোট নিয়ে বিভিন্ন ধরনের শঙ্কা ও গুজব আছে। আমরা সতর্ক আছি। গুজব, গুঞ্জন, অসন্তোষ আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারবে না। আমরা বিচলিত হব না, আমরা সব জেনে-শুনেই নির্বাচনে। নির্বাচন যথা সময়ে অনুষ্ঠিত হবে, আমাদের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। নির্বাচনে জনগণের স্বতস্ফূর্ত উপস্থিতির মাধ্যমে বিরোধীদের অপতৎপরতার জবাব দেব।’
এদিকে এবার নির্বাচনী ট্রেন মিস করেছেন জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ। মঙ্গলবার গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তিনি নিজ দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জানিয়েছেন নানা অভিযোগ।
সূত্র জানিয়েছে, জিএম কাদেরের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে ‘নালিশ’ করেছেন এরশাদপত্নী। একই সঙ্গে জিএম কাদেরের সঙ্গে জোটে না যেতেও আওয়ামী লীগ প্রধানকে অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বৈঠকে উপস্থিত মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, ‘রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, যারা এরশাদের অনুসারী, দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় পার্টি করেন, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি, আমাকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তারা বাসায় মনোনয়ন ফরম পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও তা করেনি।’
রাঙ্গা বলেন, ‘আমাদের যেসব লোক মনোনয়ন পায়নি, স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছে, তাদের জাতীয় পার্টি হিসেবে গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে জোট করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট প্রশ্নে এখনো শরিকদের ঝুলিয়ে রেখেছে। পুরোপুরি পরিষ্কার করে কিছু বলছে না। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে বলে জানানো হয়েছে। তবে প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে না আসায় আওয়ামী লীগ এবার নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় সেটা চাচ্ছে। এজন্য শেষ পর্যন্ত জোটসঙ্গীদের খুব বেশি আসনে ছাড় দেবে না বলে জানা গেছে।
এছাড়া যেসব আসনে ছাড় দেওয়া হবে সেখানেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর দায়িত্ব ক্ষমতাসীন দল নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের ছাড় পেলেও শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়ে আসা অনেকের জন্য কঠিন হতে পারে। খোদ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাও এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে পড়েছেন বেকায়দায়। গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর অনানুষ্ঠিকভাবে কয়েকজন মন্ত্রী তাদের বিরুদ্ধে ভোটে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বসিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলেন। তবে সরকার ও দলীয়প্রধান এতে সায় দেননি বলে সূত্রে জানা গেছে