জুমাবার মুসলিম উম্মাহর কাছে কাঙ্ক্ষিত দিন। সৃষ্টিজগতের শুরু থেকে দিনটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন। কোরআন ও হাদিসে এই দিনের বিশেষ সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হয়েছে। নিচে জুমার দিনের বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।
জুমার দিনে নভোমণ্ডল-ভূমণ্ডল সৃষ্টি পূর্ণতা পায়
প্রখ্যাত তাফসিরবিশারদ আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘সহিহ বর্ণনা অনুযায়ী যে ছয় দিনে জগত সৃষ্টি হয়েছে তা রোববার থেকে শুরু করে শুক্রবারে শেষ হয়। আল্লাহ তাআলা রোববার ও সোমবারে ভূমণ্ডল, মঙ্গল ও বুধবারে ভূমণ্ডলের সাজ-সরঞ্জাম তথা নদী-নালা, গাছপালা ইত্যাদি আর বৃহস্পতি ও শুক্রবারে সৃষ্টি করেন সাত আকাশ। এভাবে জুমাবার পর্যন্ত ছয় দিন পূর্ণ হয়েছে। সুতরাং পবিত্র জুমাবারেই বিশ্বজাহান সৃষ্টি পূর্ণতা লাভ করে। (তাফসির সুরা হা-মিম-সাজদা: ৯-১২; মুসলিম: ২৭৮৯)
আল্লাহ তাআলা জুমার দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেন এবং জুমার দিনেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। (মুসলিম: ২৭৮৯; আহমদ: খন্ড: ০২, পৃষ্ঠা-৩২৭; সহিহুল জামে: ৩৩৩৪)
আদম (আ.)-এর জান্নাতে প্রবেশ ও পৃথিবীতে অবতরণ
জুমার দিনে হজরত আদম (আ.)-কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। (মুসলিম: ৮৫৪)
দোয়া কবুলের দিন
জুমার দিনকে বলা হয় দোয়া কবুলের দিন। এই দিনে এমন সময় আছে যখন বান্দা আল্লাহর কাছে যা কিছুই প্রার্থনা করবে তিনি তা দেবেন। যতক্ষণ না সে হারাম কিছু প্রার্থনা করবে না। (ইবনে মাজাহ: ৮৯৫) এদিন দোয়া কবুলের জন্য আছরের সময়টি বেশি সম্ভাবনাময়। রাসুল (স.) থেকে জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, জুমার দিনে ১২ ঘণ্টা রয়েছে। তাতে এমন একটা সময়ে রয়েছে, যাতে আল্লাহর বান্দা আল্লাহর কাছে যা চায় আল্লাহ তাই দেন। অতএব তোমরা আছরের শেষ সময়ে তা তালাস করো। (আবু দাউদ: ১০৪৮, নাসায়ি: ১৩৮৯)
জুমাবারে কেয়ামত সংঘটিত হবে। হাদিসে এসেছে, মানুষ ও জ্বিন ছাড়া এমন কোনো প্রাণী নেই, যারা কেয়ামত কায়েম হওয়ার ভয়ে জুমার দিন ভোর থেকে সূর্য ওঠা পর্যন্ত চিৎকার করতে থাকে না। (মুআত্তা মালেক: ২৯১; মুসনাদে আহমদ: ১০৩০৩; আবু দাউদ: ১০৪৬; নাসায়ি: ১৪৩০; সহিহ ইবনে হিব্বান: ২৭৭২)
উম্মতে মুহাম্মদির কাছে জুমার মর্যাদা প্রকাশ
হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, আল্লাহ তাআলা আগের জাতিদের কাছে জুমার মর্যাদা অজ্ঞাত রাখেন। তাই ইহুদিরা শনিবার নির্ধারণ করে। আর খ্রিস্টানরা রবিবার নির্ধারণ করে। অতঃপর আমরা আসি। আমাদের তিনি জুমার দিনের মর্যাদা প্রকাশ করেন।’ (সহিহ মুসলিম: ৮৫৬)
কোরআনে জুমা নামে সুরা
পবিত্র কোরআনে ‘জুমুআহ’ বা জুমা (জমায়েত) নামে একটি সুরা আছে। এটি ৬২ নম্বর সুরা। এই সুরায় জুমার নামাজের গুরুত্ব বর্ণনায় আল্লাহ পাক বলছেন, ‘হে ইমানদারগণ! জুমার দিনে যখন সালাতের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনাবেচা ত্যাগ করো, এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে। (সুরা জুমা: ৯)
জুমার দিনে সুরা কাহাফ পাঠের গুরুত্ব
হাদিসে জুমার দিন সুরা কাহাফ পাঠের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ বিন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ পড়বে কেয়ামতের দিন তার পায়ের নিচ থেকে আসমানের সীমা পর্যন্ত একটি উজ্জ্বল আলো প্রকাশ পাবে যা তার চারদিক আলোকিত করবে এবং দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করা হবে।’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব: ২৯৮/১) অন্য হাদিসে সুরা কাহাফের শেষের ১০ আয়াত পাঠের সুফল হিসেবে দাজ্জালের ক্ষতি থেকে মুক্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। (সহিহ তারগিব: ১৪৭৩, আল মুসতাদরাক: ২/৩৯৯)
জুমার দিনে দরুদ পাঠের বিশেষ গুরুত্ব
জুমার দিনে দরুদ পাঠ বিশেষ আমল। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা জুমার দিনে আমার ওপর বেশি বেশি দরুদ পাঠ করো, কেননা তোমাদের পাঠকৃত দরুদ আমার সামনে পেশ করা হয়। (আবু দাউদ: ১০৪৭)
হাদিসে কুদসিতে মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন—‘তোমরা জুমার দিনে বেশি বেশি দরুদ পড়ো। কারণ, জিব্রাইল (আ.) এইমাত্র আল্লাহ তায়ালার বাণী নিয়ে হাজির হলেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যখন কোনো মুসলমান আপনার ওপর একবার দরুদ পড়ে, আমি তার ওপর দশবার রহমত নাজিল করি এবং আমার সব ফেরেশতা তার জন্য দশবার ইস্তেগফার করে।’ (তারগিব: ৩/২৯৯)
পুরো বছর সওয়াব লাভের আমল রয়েছে জুমার দিনে
আউস বিন আউস সাকাফি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন ভালো করে গোসল করল, দ্রুততর সময়ে মসজিদে গেল ও (ইমামের) কাছাকাছি বসে মনোযোগ দিয়ে (খুতবা) শুনল, তাঁর জন্য প্রতি কদমের বদলে এক বছরের রোজা ও নামাজের সওয়াব থাকবে।’ (আবু দাউদ: ৩৪৫)
জুমার দিন মসজিদে প্রথমে প্রবেশের বিশেষ মর্যাদা
রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, অতঃপর প্রথমে মসজিদে গেল সে যেন একটি উট কোরবানি করল। যে এরপর মসজিদে গেল সে যেন একটি গরু কোরবানি করল। আর যে এপর ঢুকল সে যেন ছাগল কোরবানি করল, এরপর যে ঢুকল সে যেন মুরগি কোরবানি করল, আর যে এরপর ঢুকল সে ডিম সদকা করল। অতঃপর ইমাম খুতবার জন্য এলে ফেরেশতারা আলোচনা শোনা শুরু করে।’ (সহিহ বুখারি: ৮৪১)
গুনাহ মাফের কিছু সহজ আমল
সালমান ফারসি থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করল, সাধ্যমতো পবিত্র হলো, তেল ব্যবহার করল, ঘর থেকে সুগন্ধি ব্যবহার করল, অতঃপর মসজিদে এলো, সেখানে দুজন মুসল্লির মধ্যে ফাঁক করে সামনে এগিয়ে যায় না, নির্দিষ্ট পরিমাণ নামাজ পড়ল, অতঃপর ইমাম কথা শুরু করলে চুপ থাকল; তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর দুই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহ মাফ করবেন।’ (সহিহ বুখারি: ৮৮৩)
অতএব মুসলিম উম্মাহর উচিত এই পবিত্র ও মহিমান্বত দিনকে কাজে লাগানো। এ দিনের প্রতিটি ক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এ দিনকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর তাওফিক দান করুক। আমিন।