টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সামনে চতুর্থবারের হাতছানি। তবে এবারের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে দলটিকে মুখোমুখি হতে হবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের। আর সে কারণেই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রার্থী বাছাই করছে ক্ষমতাসীন দল। মেলানো হচ্ছে নানা হিসাব-নিকাশ। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হলে যেন নিজস্ব ক্যারিশমায় বিজয়ী হয়ে আসতে পারেন সেই প্রার্থীদের প্রাধান্য দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। যাদের জনভিত্তি নেই, নানা কারণে বিতর্কিত তাদের এবার প্রার্থী না করার কথা ভাবছে দল।
ইতোমধ্যে তিন হাজার ৩৬২টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে ক্ষমতাসীন দল। গড়ে প্রতি আসনে ১১ জন করে মনোনয়ন কিনেছেন। আটটি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলেও বাকি ২৯২টি আসনে বিপুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। এর মধ্যে থেকে ৩০০ জনকে বাছাই করতে টানা কয়েক দিন ধরে বৈঠক করছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড। ইতোমধ্যে বেশির ভাগ এলাকার প্রার্থী বাছাইকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগামীকালও বৈঠকে বসবে কমিটি। কাজ সম্পন্ন হলে শনিবারই, না হলে পরদিন রোববার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
আগামী রোববার (২৬ নভেম্বর) সকালে গণভবনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সব প্রার্থীর সঙ্গে মতবিনিময় করবেন দলীয় ও সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ধারণা করা হচ্ছে, ওই মতবিনিময় সভার পর প্রকাশ করা হতে পারে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা।
ইতোমধ্যে ওবায়দুল কাদের ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তুলনামূলক বেশি জনপ্রিয় ব্যক্তিকে দল প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বর্তমান সংসদ সদস্য আছেন এমন অনেকেই বাদ পড়েছেন বলেও স্পষ্ট জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের এই মুখপাত্র।
ওবায়দুল কাদের শুক্রবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, এ পর্যন্ত চারটি বিভাগে মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে৷ আগামীকাল সম্ভব না হলে পরশু রোববার দলীয়ভাবে ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হবে। আজকের সভাতেও কিছু পুরোনো বাদ গেছে, নতুনও মনোনয়ন পেয়েছে। তবে কৌশলগত কারণে কোন কোন বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়েছে তা আর প্রকাশ করা হচ্ছে না। একসঙ্গে তিনশ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। দুটা দিন অপেক্ষা করুন।
মনোনয়নে বাদ পড়ার কারণ সম্পর্কে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, যারা উইনঅ্যাবল, ইলেক্টঅ্যাবল না, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অনেকেই হারিয়ে ফেলেছেন। নারী-পুরুষ সব প্রার্থীর ক্ষেত্রেই মনোনয়নে এটা প্রযোজ্য।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের সভায় ছিলেন দলের দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, জনপ্রিয় প্রার্থী বাছাই করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় জরিপ চালানো হয়েছে। একই সঙ্গে দলে তার সম্পৃক্ততা, অতীত অবদান, গ্রহণযোগ্যতা- এসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এগুলো সম্পর্কে জানতে আগেই একাধিক জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে।
জরিপের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। গত ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায় শেখ হাসিনা বলেন, জরিপের ভিত্তিতে যোগ্য ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ও সার্ভে রিপোর্টের ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়া হবে। যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে তার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।
ওই সভায় যোগ দিয়েছিলেন এমন বেশ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী দলের মনোনয়নের বিষয়ে এমপিদের উদ্দেশে পরিষ্কার কিছু বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কাউকে জিতিয়ে আনার দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আমি কারও চেহারা দেখে মনোনয়ন দেব না। দেখেশুনে জনপ্রিয় ব্যক্তিদের নমিনেশন দেব। এখানে (সংসদীয় দলের সভায়) যারা আছেন সবাই মনোনয়ন নাও পেতে পারেন।
এদিকে দলের নেতারা ৩০০ আসনে প্রার্থী ঠিক করার কথা বললেও আওয়ামী লীগ তাদের জোটসঙ্গীদের জন্য কিছু আসন ছেড়ে দিয়েই প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। একাদশ সংসদেও আওয়ামী লীগের জোট মিত্র ওয়ার্কার্স পার্টির একটি সংরক্ষিত নারী আসনসহ মোট চারটি, জাসদের একটি নারী আসনসহ তিনটি, বিকল্পধারা দুটি এবং তরিকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি)র একজন করে সংসদ সদস্য আছেন। এবারে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও জোট ও মিত্রদের জন্য কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার কথা আগেই জানিয়েছেন দলের নেতারা।
এসব বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, জোট হতেও পারে নির্বাচনের আগে, সময় আছে। কাজেই তালিকাও আসতে পারে। এমনও হতে পারে আপনিও ভাবছেন না, আমিও ভাবছি না। কিন্তু কার সঙ্গে কার জোট হয়, কেউ ভাবতে পারে না।
আরও পড়ুন: মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় বিতর্কিতরা
সূত্র জানিয়েছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার জয়ের সম্ভাবনা বেশি, তা জানতে একাধিক সংস্থা দলের তৃণমূল ও জনগণের ওপর বেশ কয়েকটি জরিপ চালায়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ৯০ জন বর্তমান সংসদ সদস্য বিতর্কিতের তালিকায় রয়েছেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও দলীয় কমিটিতে নেতা মনোনয়নে স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতিত্ব, টেন্ডারবাজি, টাকার বিনিময়ে মানুষকে চাকরি দেওয়া এবং দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল উসেক দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচন। নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর; বাছাই ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। তবে তফসিল পুনর্গঠনের সম্ভাবনা আছে বলে সূত্র দাবি করেছে। কারণ, বিএনপি ভোটে অংশ নেবে না এমনটা বিবেচনায় নিয়ে অন্যান্য দল ও ব্যক্তিদের বেশি সংখ্যায় ভোটের আনার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন দলটি। এজন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় বাড়তে পারে। যদিও ভোটের তারিখ পেছানোর সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।