Monday, April 29, 2024
HomeScrollingজীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১১ জন

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ১১ জন

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিতে গ্যাস লিকেজ থেকে এসি বিস্ফোরণ ঘটে দগ্ধ ৩৭ মুসল্লিদের একে একে জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মৃতু্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ জনে। চিকিৎসাধীন দগ্ধ আরো ১১ জন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাদের নিয়েও শঙ্কা কাটছে না চিকিৎসকদের। ২৫ জনের লাশ ইতোমধ্যে হস্তান্তর শেষ করেছে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক কর্তৃপক্ষ। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে এসব লাশ বুঝে নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় দাফন শেষ করেছেন স্বজনরা। এদিকে এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের স্বজনদের নির্ঘুম রাত কাটছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাত জামে মসজিদ থেকে দগ্ধ অবস্থায় যে ৩৭ জনকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছিল। শনিবার রাত পর্যন্ত তাদের মধ্যে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত মারা যান জুলহাস উদ্দিন (৩০), শামীম হাসান (৪৫) ও মোহাম্মদ আলী মাস্টার (৫৫) ও আবুল বাশার মোল্লা (৫১)। তাদের নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৫ জন হয়। রাতে মারা যান বরিশালের বাকেরগঞ্জের বারঘড়িয়া গ্রামের সোবাহান ফরাজীর ছেলে মনির ফরাজী (৩০)। এর ফলে মৃতের সংখ্যা ২৬ এ দাঁড়ায়।

শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. হোসাইন ইমাম বলেন, রোগী তো সব চলে যাচ্ছে, তাদের তো ধরে রাখতে পারছি না। যেখানে বাঁচার আশা করার কিছু নেই, এর থেকে বড় হতাশার কিছু থাকতে পারে না! দগ্ধদের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, চেহারা চেনা যাচ্ছে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। হাত-পা সব পোড়া, একটা ক্যানুলা দেয়ার অবস্থা পর্যন্ত নেই। বেশিরভাগ মানুষের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের ড্রেসিং করে র‌্যাপ-আপ করতে একটা মানুষের কমপক্ষে আধা ঘণ্টা সময় চলে যায়।

স্বল্প সময়ে দগ্ধদের একে এক মারা যাওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘শনিবার সারাদিন হাসপাতালে ছিলাম, কিন্তু প্রতি মিনিটে শুনছি, স্যার ওমুক নাই, স্যার আরেকজন মারা গেছেন, স্যার এই রোগী মারা গেছেন। শনিবার রাতে গুনে গুনে ২১ জন রোগী মারা গেল। হয়ত আগামী কয়েকদিনে আমরা আরও কিছু মানুষকে হারিয়ে ফেলবো। ‘আমরা তো খুব সহজে বলে ফেলি, কাল সংখ্যাটা হয়তো আরো বাড়বে। বেঁচে যে থাকবে, বাঁচার যে আশা আসলে কারো নেই। আমরা হিসাব করে রেখেছি, চারজন রোগীর ৫০ শতাংশের নিচে বার্ন কিন্তু তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। এখন যে কথা বলছে, আমি জানি আগামী তিন দিন পর সে কথা বলতে পারবে না, ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারবে না।’

হাসপাতাল সূত্র জানায়, এ ঘটনায় দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি থাকা রোগীর মধ্যে এখন ১১ জন আছেন। তারা মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন, সবার অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রত্যেকেরই শ্বাসনালী, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে ৪ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানান, যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেকেরই শ্বাসনালীসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে। প্রত্যেকের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দগ্ধ রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সবধরনের সেবা দিতে চিকিৎসরা ব্যাপক শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ইতোমধ্যে ২৬ জন মারা গেছেন। বাকি ১১ জনকে সুস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিকিৎসকরা।

যে ১১ জন চিকিৎসাধীন আছেন তাদের মধ্যে ছয়জন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন। চিকিৎসাধীন ১১ জনের কেউ শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, নারায়ণগঞ্জ মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় দগ্ধ ৩৭ জনের মধ্যে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও ১১ জন চিকিৎসাধীন আছেন। তারাও শঙ্কামুক্ত নয়। দগ্ধ ১১ জনের মধ্যে ৬ জনকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে।

চিকিৎসাধীন যারা: ময়মনসিংহের ত্রিশালের আব্দুর রহমানের ছেলে ফরিদ (৫৫), কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার চর আলগী গ্রামের এমদাদুল হকের ছেলে শেখ ফরিদ (২১), পটুয়াখালীর চুন্নু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ কেনান (২৪), পটুয়াখালীর মোহাম্মদ রাজ্জাকের ছেলে নজরুল ইসলাম (৫০), নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার পশ্চিম তল্লার মো. স্বপনের ছেলে সিফাত (১৮), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা আফজালের ছেলে হান্নান (৫০), একই এলাকার আব্দুল মান্নানের ছেলে আব্দুস সাত্তার (৪০), নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসিরহাট গ্রামের আবদুল আহাদের ছেলে আমজাদ (৩৭), পটুয়াখালীর ধুমকির চর বয়রা গ্রামের লতিফ হাওলাদারের ছেলে মামুন (২৩), শরীয়তপুরের নড়িয়ার আলাল শেখের ছেলে ইমরান (৩০) ও শরীয়তপুরের নড়িয়া কেদারপুর গ্রামের মনু মিয়ার ছেলে আব্দুল আজিজ (৪০)।

স্বজনদের কণ্ঠে বিচার দাবি: এখনও যারা বেঁচে আছেন তাদের স্বজনদের নিঘুম রাত কাটছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের এক করিডোর থেকে অন্য করিডোরে। ইতোমধ্যে যে ২৬ জন মারা গেছেন তাদের স্বজনদের চোখে কোন ঘুম ছিল না, ছিল না খাওয়া দাওয়া। নিহত এবং দগ্ধ হয়ে এখনও বেঁচে থাকাদের স্বজনদের কণ্ঠে এক বাক্য, এ ঘটনায় যাদের গাফিলতি ছিল তাদের বিচার হতে হবে। কোনভাবেই যেন কেউ ছাড় না পায়। তিতাস গ্যাস, মসজিদ কমিটি যে বা যাদের গাফিলতি ছিল, যারা গ্যাসলাইনের ওপর মসজিদ নির্মাণের সময় দায়িত্ব এড়িয়ে গেছেন, গ্যাস লাইন লিকেজ হওয়ার পর বলার পরও কেন লাইন ঠিক হয়নি, কেন ঘুষ চাওয়া হয়েছে, ঘুষের জন্য লাইন ঠিক করতে না পারার বিষয়টি মসজিদ কমিটি কেন প্রশাসনকে জানায়নি সব বিষয় তদন্ত করে বিচার চান স্বজনরা।

রোববার সকাল আটটায় মারা গেছেন মোহাম্মদ আলী নামে এক শিক্ষক। দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করায় তাকে সবাই জানেন এবং চেনেন ‘আলী মাস্টার’ হিসেবে। ইনস্টিটিউটের লবিতে মামাতো ভাই রিয়াদের কাঁধে মাথা রেখে বার বার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন আলী মাস্টারের মেঝ ছেলে রাসেল। বার্ন ইউনিটের ভেতরে দগ্ধদের আর্তনাদ। তিনি বললেন, আমাদের বাসার পাশেই মসজিদ। আব্বা এখানেই প্রতিদিন নামাজ পড়তে যেতেন। চেষ্টা করতেন সবার আগে যেতে। শুক্রবারও গিয়েছিলেন। আগুনে পুড়ে হেঁটে হেঁটে বাসায় ফিরে বার বার বলছিলেন, ‘আমার গায়ে মলম দাও, জ্বলে যাচ্ছে পুরো শরীর। আমাদের সবাইকে কাঁদিয়ে আব্বা চলে গেলেন। জানি না তাকে হারানোর এই শোক আমরা কিভাবে সইবো?

আলী মাস্টারের ভাগিনা রিয়াদ বলেন, মসজিদ কমিটি আগেই তিতাস গ্যাসকে গ্যাস লিক হওয়ার কথা অবগত করেছিল। তারা লিখিত অভিযোগ না দেয়ার কারণে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। তারা ৫০ হাজার টাকা ঘুষও চেয়েছিল। ‘তিতাস ঠিকমতো ব্যবস্থা নিলে এ ঘটনা ঘটতো না। এতগুলো মানুষের মৃত্যু হতো না। আমরা এর বিচার চাই। ’

রহিমা বেগম এ ঘটনায় হারিয়েছেন স্বামী জালহাস এবং ৬ বছরের ছেলে জুবায়েরকে। তিনি এখন পাগলপ্রায়। শনিবার ছেলে ও রোববার তার স্বামী মারা যায়। রোববার জুলহাস মিয়ার মরদেহ নিতে এসে তার ফুপাতো ভাই নাহিদ হাসান শাকিল বলেন, সকালে ভাতিসা জোবায়ের দাফন সম্পন্ন হয়েছে পটুয়াখালীতে। এরপর মারা গেছেন আমার ভাই জুলহাস। জানি না, ভাবি কিভাবে এই শোক সহ্য করবেন? কিভাবে তার বাকি জীবন চলবে?

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন আমজাদ। বার্ন ইউনিটের এক লবি থেকে অন্য লবিতে দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত বাবা আবদুল আহাদ। ছেলের চিন্তায় তার নাওয়া খাওয়া সবকিছু ফিকে হয়ে গেছে। অসহায় এ বাবা সাংবাদিকদের বলেন আমার চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক মরদেহ বেরোচ্ছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমার জমিজমা যা কিছু সব বেচে দেব, আমারে আমার ছেলে ফিরিয়ে দিন। আমার ছেলে পোশাক কারখানার গাড়ি চালাত। তার রোজগারে আমাদের সংসার চলতো। আমার ছেলেরে ফিরায়া দাও।

প্রাণ গেছে যাদের: চাঁদপুর সদর উপজেলার করিম মিজির ছেলে মোস্তফা কামাল (৩৪), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার নিউখানপুর ব্যাংক কলোনির আনোয়ার হোসেনের ছেলে কলেজ শিক্ষার্থী রিফাত (১৮), চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার শেখদী গ্রামের মৃত মহসিনের ছেলে মাইনুউদ্দিন (১২), নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার সেকান্দর মিয়ার ছেলে মো. রাসেল (৩৪), লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী থানার পলাশী গ্রামের মেহের আলীর ছেলে নয়ন (২৭), ফতুল্লার আব্দুল খালেকের ছেলে বাহার উদ্দিন (৫৫), শরীয়তপুরের নড়িয়ায় কালিয়াপ্রাসাদ গ্রামের নুর উদ্দিনের ছেলে জুবায়ের (১৮), নড়িয়ায় কালিয়াপ্রাসাদ গ্রামের নুর উদ্দিনের ছেলে সাব্বির (২১), ফতুল্লার তল্লার আনোয়ার হোসেনের ছেলে জয়নাল (৫০), মুন্সীগঞ্জের লৌহজং হাটবুকদিয়া গ্রামের জইন উদ্দিন বেপারীর ছেলে কুদ্দুস বেপারী (৭০), পটুয়াখালী রাঙ্গাবালীর বাহেরচরের বাচ্চু ফরাজীর ছেলে জুলহাস উদ্দিন (৩০), জুলহাস উদ্দিনের ছেলে জুয়েল (৭), মসজিদের মুয়াজ্জিন কুমিল্লা লাঙ্গলকোটের বদরপুর গ্রামের দেলোয়ার হোসেন (৪৮), মুয়াজ্জিন দেলোয়ারের ছেলে জুনায়েদ (১৭), মসজিদের ইমাম কুমিল্লার মুরাদনগরের পুটিয়াজুড়ি গ্রামের আব্দুল মালেক (৬০), খুলনার খানজাহান আলী থানার মীরের জঙ্গা গ্রামের কাদের হাওলাদারের ছেলে কাঞ্চন হাওলাদার (৫৩), পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী কাউখালী গ্রামের বেলায়েত বারীর ছেলে জামাল আবেদিন (৪০), রাঙ্গাবালীর সেনের হাওলার সাজাহান পেদার ছেলে নিজাম (৪০), নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মজিদের ছেলে নাদিম (৪৫), ফতল্লা এলাকার কফিল উদ্দিন শেখের ছেলে হুমায়ুন কবির (৭০), পটুয়াখালী সদর উপজেলার দড়িতালুক গ্রামের আব্দুল হক বিশ্বাসের ছেলে মোহাম্মদ ইব্রাহিম বিশ্বাস (৪৩), পটুয়াখালীর গলাচিপা খালেক হাওলাদারের ছেলে মোহাম্মদ রাশেদ (৩০), মসজিদ কমিটির কোষাধ্যক্ষ চাঁদপুরের মতলব থানার সুজাপুর গ্রামের শামীম হাসান (৪৫), ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা মকবুলের ছেলে মোহাম্মদ আলী মাস্টার (৫৫), আবুল বাশার মোল্লা (৫১), বরিশালের বাকেরগঞ্জের বারঘড়িয়া গ্রামের সোবাহান ফরাজীর ছেলে মনির ফরাজী (৩০)।

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments