
আজকের পৃথিবী অভূতপূর্ব রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব মানুষের হাতে এনে দিয়েছে ত্বরিত যোগাযোগের সুযোগ, খুলে দিয়েছে চিন্তা–বিশ্বাসের নতুন দিগন্ত। যুগে যুগে মানুষ প্রভাবিত হয়েছে নানা শ্রেণির ব্যক্তিত্ব দ্বারা—কখনো কবি, কখনো রাজনীতিক, আবার কখনো চিন্তাবিদ। কিন্তু ডিজিটাল যুগে সেই প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দু দখল করেছেন ইন্টারনেট তারকা বা ইনফ্লুয়েন্সাররা, যারা তাদের কথাবার্তা, আচরণ ও জীবনধারার মাধ্যমে কোটি মানুষের চিন্তা ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করছেন।
এই বাস্তবতা ইসলাম উপেক্ষা করতে পারে না। কারণ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও সময়োপযোগী জীবনব্যবস্থা। তাই প্রশ্ন উঠছে- আজকের ডিজিটাল দাওয়াতে নেতৃত্ব দেবেন কে? ঐতিহ্যবাহী আলেম, নাকি আধুনিক ইনফ্লুয়েন্সার?
আলেম: জ্ঞানের ভিত্তি ও দায়িত্বের ধারক
আলেমগণ ইসলামের গভীর জ্ঞানের ধারক-বাহক। যুগে যুগে তারা কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে সমাজকে পথ দেখিয়েছেন। তাদের জ্ঞান অর্জিত হয় দীর্ঘ অধ্যয়ন, গবেষণা ও ত্যাগের মাধ্যমে। ফলে তাদের ব্যাখ্যা বিশ্বাসযোগ্য ও শরিয়তসম্মত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সুরা জুমার: ৯)
তবে অনেক আলেম এখনো ডিজিটাল যোগাযোগের ভাষা ও কৌশলে অভ্যস্ত নন; ফলে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছাতে সময় লাগছে। অথচ ইসলামি জ্ঞান প্রচারে তাদের ভূমিকা এখনো অপরিহার্য।
ইনফ্লুয়েন্সার: আধুনিক প্রভাবের শক্তি
অন্যদিকে ইনফ্লুয়েন্সাররা আজকের যুগে মানুষের চিন্তা ও আচরণে বিশাল প্রভাব ফেলছেন। কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও, সংক্ষিপ্ত বার্তা বা রিলসের মাধ্যমে তারা পৌঁছে যাচ্ছেন লাখো মানুষের কাছে, যাদের অনেকেই হয়তো কোনো মসজিদ বা ইসলামি আলোচনায় অংশ নেন না।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘জ্ঞানের কথা প্রচার কর, যদি তা একটিমাত্র আয়াতও হয়।’ (সহিহ বুখারি: ৩৪৬১)
এ দিক থেকে ইনফ্লুয়েন্সাররা ইসলামের দাওয়াতের নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। তারা আধুনিক ভাষা, ইনফোগ্রাফিক, ভিডিও ও লাইভের মাধ্যমে ইসলামকে সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারেন।
কিন্তু এখানেই রয়েছে বড় ঝুঁকি। সোশ্যাল মিডিয়ার জনপ্রিয়তা ও ‘লাইকের মোহ’ অনেককে সত্যিকার দাওয়াতের উদ্দেশ্য থেকে সরিয়ে দেয়। ইসলামি জ্ঞানের অভাবে কেউ কেউ ভুল ব্যাখ্যা বা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেন, যা উম্মাহর জন্য বিপজ্জনক। কেউ আবার দর্শক টানার জন্য অশালীন ভঙ্গি বা অতিরঞ্জন ব্যবহার করেন। এই অতিরঞ্জনের কারণে ভুল প্রচারণা বা ভুল হাদিস প্রচারের সম্ভাবনাও রয়ে যায়। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘যে কেউ ইচ্ছে করে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামকেই তার ঠিকানা নির্দিষ্ট করে নিল। (সহিহ বুখারি: ৩৪৬১) অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) সতর্ক করেছেন- ‘যে ব্যক্তিকে অজ্ঞতা প্রসূত ফতোয়া দেয়া হয় তার পাপ ফাতোয়াদানকারীর উপর বর্তাবে।’ (আবু দাউদ: ৩৬৫৭)
আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন- ‘হে মুমিনগণ! কোনো ফাসিক যদি তোমাদের কাছে সংবাদ আনে, তা যাচাই করো।’ (সুরা হুজরাত: ৬)
এসব নির্দেশনা শুধু সাধারণ মানুষের জন্য নয়; দাওয়াতদাতার জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য।
আলেম ইনফ্লুয়েন্সার: সমন্বয়ের সেতুবন্ধন
আজকের যুগে এমন কিছু তরুণ আলেম রয়েছেন, যারা কোরআন-সুন্নাহর গভীর জ্ঞান রাখার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষা বোঝেন। তাঁরা একদিকে প্রামাণিক জ্ঞানের ধারক, অন্যদিকে দক্ষ উপস্থাপক। এই শ্রেণির মানুষই হতে পারেন ইসলামি দাওয়াতের আদর্শ মডেল—যেখানে আলেমের প্রজ্ঞা ও ইনফ্লুয়েন্সারের প্রভাব একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে ভারসাম্যপূর্ণ দাওয়াতের ধারা। তাঁরা ইসলামের শিক্ষাকে তুলে ধরেন আকর্ষণীয় উপায়ে, অথচ শরিয়ত থেকে বিচ্যুত না হয়ে।
এমন আলেম-ইনফ্লুয়েন্সাররাই প্রমাণ করেন- ইসলাম আধুনিক মাধ্যমের পরিপন্থী নয়; বরং সেগুলোকেই হেদায়াতের উপকরণে রূপ দিতে পারে।
নিয়ত: দাওয়াতের প্রাণ
ইসলামে কাজের মূল্য নির্ধারিত হয় নিয়তের ভিত্তিতে। আলেম হোন বা ইনফ্লুয়েন্সার—উভয়েরই লক্ষ্য হওয়া উচিত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘কাজসমূহ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল, আর প্রত্যেক মানুষ পাবে তার নিয়ত অনুযায়ী।’ (সহিহ বুখারি: ১)
আরেক হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে- ‘যে জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা হয়, যদি কেউ সেই জ্ঞান পার্থিব স্বার্থ সিদ্ধির জন্য শিক্ষা করে, তবে সে কেয়ামতের দিন জান্নাতের সুবাসও পাবে না।’ (সুনান ইবনে মাজাহ: ২৫২)
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলি (রহ.) বলেন, ‘মানুষের চোখে বড় হতে চাওয়ার চেয়ে ভয়ংকর রোগ আর কিছু নেই।’ (জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম) অর্থাৎ, খ্যাতির নেশা ইসলামি দাওয়াতের মর্মবস্তু নষ্ট করে দেয়।
প্রজ্ঞা ও ভারসাম্যের ইসলামি দৃষ্টিকোণ
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি মানুষকে দাওয়াত দিন আপনার রবের পথে হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল: ১২৫)
এই আয়াত দাওয়াতের তিনটি স্তম্ভ স্পষ্ট করে- ১. আলেমের প্রজ্ঞা ২. ইনফ্লুয়েন্সারের উপদেশ এবং ৩. উভয়ের উত্তম আলোচনার ধরণ। দাওয়াত তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও উপস্থাপনার দক্ষতা একত্রিত হবে।
সচেতন ব্যবহারকারীর ভূমিকা
সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে আলোকিত ও অন্ধকার দুই দিকই আছে। একজন সচেতন মুসলিমের দায়িত্ব হলো কল্যাণকর দিক বেছে নেওয়া। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘অনর্থক বিষয় পরিত্যাগ করা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য।’ (জামে তিরমিজি: ২৩১৭)
অতএব, আমাদের উচিত উপকারী কনটেন্ট প্রচার করা, গুজব থেকে বিরত থাকা এবং সময়ের সঠিক ব্যবহার করা।
নবী (স.) বলেন, ‘পাঁচটি জিনিসকে গনিমত মনে করো- যুবককাল বার্ধক্যের আগে, অবসর ব্যস্ততার আগে, জীবন মৃত্যুর আগে…’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা: ৩৪৪৩৬)
এই সতর্কবাণী আমাদের সময়ের মূল্য স্মরণ করিয়ে দেয়, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে।
সারকথা: সমন্বয়েই হেদায়াতের সেতু
সোশ্যাল মিডিয়ায় ইসলামি প্রচারণা আলেম বনাম ইনফ্লুয়েন্সার নয়, বরং আলেম ও ইনফ্লুয়েন্সারের সমন্বয়। আলেম জ্ঞানের রক্ষক ও প্রামাণিকতার নিশ্চয়তা দেবেন, আর ইনফ্লুয়েন্সার সেই জ্ঞানকে আধুনিক ভাষা ও মাধ্যমের মাধ্যমে পৌঁছে দেবেন বৃহত্তর সমাজে। দাওয়াতের সাফল্য নির্ভর করে- জ্ঞানের গভীরতা, উপস্থাপনার প্রজ্ঞা এবং নিয়তের পবিত্রতার ওপর। আর উদ্দেশ্য হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবই আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।’ (সুরা আনআম: ১৬২)
অতএব, সোশ্যাল মিডিয়াকে বিভ্রান্তির মঞ্চ নয়, বরং হেদায়াত ও কল্যাণের ময়দান হিসেবে গড়ে তোলাই হোক আমাদের উদ্দেশ্য ও প্রচেষ্টা।
