
শাহজাহান খান দীর্ঘ ৪ বছর ধরে বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। সর্বশেষ অসুস্থ হয়ে তিনি ফরিদপুর হার্ট ফাউন্ডেশনে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বুধবার বাদ জোহর মাদারীপুর পৌর ঈদগাহ মাঠে তার নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সাংবাদিক শাহজাহান খান দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার মাদারীপুর জেলা সংবাদদাতা ছাড়াও স্থানীয় দৈনিক সুবর্ণগ্রাম পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তিনি দীর্ঘ ৫৫ বছর মফস্বল সাংবাদিকতায় অনন্য অবদান রেখেছেন। এর জন্য গত তিন বছর আগে বসুন্ধরা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২১ লাভ করেন।
এই প্রবীণ সাংবাদিকের মৃত্যুতে মাদারীপুর জেলায় কর্মরত সকল সাংবাদিক, অনলাইন প্রেসক্লাব মাদারীপুর ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। পাশাপাশি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়েছে।
জানা যায়, তৎকালীন ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমা সদরের পাবলিক লাইব্রেরীর অদূরেই ছিলো শাহজাহান খানের বাড়ি। তিনি ছোট বেলা থেকেই ছিলেন পত্রিকা প্রেমি ও লেখক ভক্ত। ৯ম শ্রেণি থেকেই নিয়মিত পত্রিকা পড়া শুরু করেছিলেন শাহজাহান। সময় পেলেই গিয়ে বসতেন লাইব্রেরীতে। চোখ বুলাতেন লাইব্রেরীতে রাখা প্রতিদিনের পত্রিকার প্রতিটি পাতায়। তখন থেকেই নিয়মিত দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ পড়া শুরু করেন। তবে তখন লাইব্রেরিতে রাখা হতো না সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো। প্রতি সপ্তাহের সোমবার সকালে ঢাকা থেকে লঞ্চ যোগে মাদারীপুর পুরান বাজার এলাকার নেছারিয়া লাইব্রেরিতে আসতো এসব সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো। সপ্তাহের সোমবার আসলেই শাহজাহান খান বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার পথ পায়ে হেটে যেতেন নেছারিয়া লাইব্রেরিতে। তখনকার সময়ে মাদারীপুরের একমাত্র পত্রিকার এজেন্ট ছিলো খন্দকার নেসার আহম্মেদ। তার থেকে আট আনা পয়সা দিয়ে কিনে আনতেন সাপ্তাহিক পত্রিকা পূর্বদেশ। এভাবে প্রতি সপ্তাহে নেছারিয়া লাইব্রেরিতে যাতায়াতের ফলে, পত্রিকার এজেন্ট খন্দকার নেসার আহম্মেদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে তার। তাই মাঝেমধ্যে খুশি হয়েই মূল্য ছাড়াই তাকে দিয়ে দিতেন পত্রিকা। এই পত্রিকা পড়ার নেশা থেকেই একদিন হয়ে উঠেন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদকর্মী। বর্তমান শরীয়তপুর জেলা ছিলো তখনকার মাদারীপুর মহকুমার অংশ তাই সংবাদ সংগ্রহে কখনো পায়ে হেটে কখনো বা নৌকা যোগে যেতেন সংবাদ সংগ্রহে। সাংবাদিকতা করতে এসে তাকে অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে।
আরও জানা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী সময় দুই দুই বার সরকারি চাকুরী পান তিনি। কিন্তু সংবাদপত্রের মোহ ছেড়ে বের হয়ে আসতে পারেননি সাংবাদিক শাহজাহান। গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে লাঞ্চিত হয়েছেন মন্ত্রীর হাতে। জেলা প্রশাসকের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের রোষানলে পড়তে হয়েছে বারংবার। তবুও তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। একজন নির্ভরযোগ্য সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন মাদারীপুরের মানুষের কাছে। শাহজাহান খান তখনকার সময়ে নির্বাচিত হন মাদারীপুর প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। পরে প্রেসক্লাবের কার্য-নির্বাহী সদস্য, সাধারণ সম্পাদক, আহবায়ক ও সর্বশেষ প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে ২০২৫ সাল, এই দীর্ঘ ৫৫ বছর ধরে ছিলেন এই সাংবাদিকতা পেশায়।
প্রবীণ সাংবাদিক শাহজাহান খান ১৯৬৬ সালে মাদারীপুর ইউনাইটেড ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরে পড়াশোনা জন্য ভর্তি হন ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। কিন্তু সেশন জটের কারনে সেখান থেকে চলে আসেন মাদারীপুরে। মাদারীপুরে এসে নাজিমউদ্দীন কলেজে শুরু করেন পড়াশোনা। কলেজে পড়াকালীন সময়ে ১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের খবর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবর দেখে শাজাহান খানের নেশা জাগে সাংবাদিকতায়। তিনি কাজ শুরু করেন তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমা সংবাদদাতা ডা. এম এম কাসেমের সাথে। তার অনুপ্রেরণায় সংবাদ প্রেরণ শুরু করেন সাপ্তাহিক পূর্বদেশে। তার লেখা সংবাদ ছাপা হতে থাকে সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকায়। এরপর সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকা দৈনিকে রুপান্তরিত হয়। তখন সেই পত্রিকায় মাদারীপুর মহকুমার সংবাদদাতা হিসেবে আবেদন করেন তিনি। ১৯৭০ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর মাদারীপুর মহকুমার সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ পেয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই জুন পর্যন্ত কাজ করেন। এরপর দৈনিক পূর্বদেশ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কাজ করেন দৈনিক নিউ ন্যাশন পত্রিকার মাদারীপুর করেসপন্ডেন্ট হিসেবে। প্রায় ২ বছর কাজ করেন সেখানে। এরপরে ১৯৭৫ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় মাসিক ২০ টাকা সম্মানি ভাতায় নিয়োগ প্রাপ্ত হন তিনি। সেই থেকে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় জেলা প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।