Tuesday, July 1, 2025
HomeScrollingসুস্থ হলেও দীর্ঘসময় ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু, প্রভাব ফেলেছে মানসিক স্বাস্থ্যেও

সুস্থ হলেও দীর্ঘসময় ভোগাচ্ছে ডেঙ্গু, প্রভাব ফেলেছে মানসিক স্বাস্থ্যেও

# ডেঙ্গু থেকে সুস্থ হলেও নানা জটিলতায় ভুগছেন অনেকে

# বয়স্ক ও নানা রোগে আক্রান্তরা ভুগছেন বেশি

# অন্তত ছয় মাস নানা জটিলতায় ভোগেন: বলছে গবেষণা

# ডেঙ্গু পরবর্তী জটিলতায় চিকিৎসকের অভিমত গ্রহণের পরামর্শ

রাজধানীর কালশি এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম (৫৭) একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগী। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় চিকিৎসা নিলেও দ্রুত সময়ের মধ্যে তার অবস্থার অবনতি হয়। এমনকি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও (আইসিইউ) ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয় তাকে। শুরুতে প্লাটিলেট স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ করেই তা আশঙ্কাজনক হারে কমে যায় এবং রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে যেতে থাকে। সপ্তাহখানেক চিকিৎসায় বাসায় ফিরলেও তার ফুসফুসে পানি জমে এবং লিভারেও সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক দুর্বলতার কারণে এখনও তার রক্তচাপ স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। যা তার প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে।

বাসাবোর বাসিন্দা নুর-উন-নাহার উইলির পরিস্থিতি আরও জটিল। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার উইলি সাম্প্রতিক সময়ে তৃতীয়বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। তার পরিবারের প্রায় সবাই ডেঙ্গুর শিকার হয়েছেন, এমনকি চলতি বছর তার পাঁচ বছর বয়সী মেয়েও সিভিয়ার হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। ডেঙ্গুর পাশাপাশি তার চিকনগুনিয়া ধরা পড়ে তার। ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া থেকে সুস্থ হলেও নাহার জয়েন্ট পেইন, ক্লান্তি ও অবসাদে ভুগছেন। স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছেন না তিনি। এর তাদের পরিবারের জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হয়েছে, তেমনই আর্থিক ও মানসিক চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে।

মরিয়ম ও উইলির মতো অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুর মতো মশাবাহিত রোগ পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিলতায় ভুগছেন।

এদিকে ডেঙ্গু জ্বরের প্রভাব বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ডেঙ্গুর এমন অবস্থা দীর্ঘমেয়াদে মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মাঝে দেখা দিচ্ছে নানা জটিলতা, যা তাদের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করছে এবং শারীরিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ দেশি-বিদেশি একাধিক গবেষণাতেও এ চিত্র দেখা যাচ্ছে।

যা বলছেন ভুক্তভোগীরা

মরিয়ম বেগমের ছেলে এমকেএইচ শিশির ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আম্মু গত ৩১ অক্টোবর অফিস থেকে জ্বর নিয়ে বাড়ি ফেরেন। পরদিন সিবিসি পরীক্ষায় দেখা যায় প্লাটিলেট ৩ লাখ ৩০ হাজার; পটাশিয়াম ও সোডিয়াম লেভেল স্বাভাবিক ছিল, তবে খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বমি হচ্ছিল। এ অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। ৩ নভেম্বর পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও সন্ধ্যায় পুনরায় বমি শুরু হয়। ৪ নভেম্বর আবার সিবিসি পরীক্ষায় প্লাটিলেট সংখ্যা নেমে আসে ৫৫ হাজারে, পটাশিয়াম ও সোডিয়াম লেভেলও কমে যায়। ওই সন্ধ্যায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং প্লাটিলেট দ্রুত নেমে আসে—রাত ১১টার মধ্যে তা ১৭ হাজারে পৌঁছে এবং রক্তচাপ নেমে যায় ৮০/৬০-এ। পরবর্তীতে ফুসফুসে পানি জমে এবং লিভারে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়, ফলে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে তিনি তিন দিন ও পরে সাধারণ বেডে দুই দিন ছিলেন।’

বর্তমান অবস্থার কথা জানিয়ে শিশির বলেন, বাসায় ফেরার পরও তার রক্তচাপ স্বাভাবিক নয়। প্রতিনিয়ত তা উঠানামা করছে। বেশিরভাগ সময় তা নিম্নমুখী। যদিও তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। বর্তমানে তিনি খুবই দুর্বল এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও রয়েছে।

নিজের ভায়নক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে নুর-উন-নাহার উইলি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘২৩ অক্টোবর থেকে আমি অসুস্থ। জ্বর ছিল ১০৩-১০৪ ডিগ্রি। পরে ২৮ অক্টোবর আমার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে, একইদিনে চিকনগুনিয়া ধরা পড়ে। এটি আমার তৃতীয়বারের মতো ডেঙ্গু। আগেরবার ডেঙ্গুতে বমিসহ বেশ কিছু সমস্যা ছিল, এবার সেগুলো কম থাকায় হাসপাতালে যেতে হয়নি। বাসায় লিকুইড ম্যানেজমেন্ট করেই চলছিল। একইসময়ে আমার স্বামীরও একই উপসর্গের জ্বর ছিল, যদিও সে টেস্ট করেনি। এ বছর আমার মেয়েও সিভিয়ার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল।

তীব্র যন্ত্রণার কথা জানিয়ে নুর-উন-নাহার বলেন, ‘আমি বাসাবো এলাকায় থাকি। আর গত বছর আমাদের পুরো পরিবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল, যা এ বছর আবারও ঘটল। আমার পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে জুন-জুলাইয়ে সিভিয়ার হেমোরেজ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল। প্রথমে সে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি ছিল, তারপর দ্বিতীয়বার ইনফেকশন ধরা পড়ায় তাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। বর্তমানে আমার ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া নেগেটিভ। তবে পায়ের জয়েন্টের ব্যথা এখনও আছে। আগে জ্বরের সময় রক্তচাপও কমে যেত, যা এখনও স্থিতিশীল না। প্রচণ্ড শরীর ব্যথা এবং হাত-পায়ের প্রতিটি জয়েন্টে তীব্র ব্যথা, যার কারণে এখনও ঠিকমতো হাঁটতে পারি না। ফলে স্বাভাবিকভাবে বাইরে যাওয়া বা কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না।’

গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তির চিত্র

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৯ সালের ডেঙ্গু সংক্রান্ত এক গবেষণায় আক্রান্তদের দীর্ঘমেয়াদি নানা জটিলতায় ভোগার বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা যায়, ডেঙ্গু সেরে ওঠার পরেও রোগীদের মধ্যে মাসের পর মাস ক্লান্তি, জয়েন্ট ও মাংসপেশির ব্যথা এবং শারীরিক দুর্বলতা থাকে। এই সমস্যাগুলোকে পোস্ট-ভাইরাল ফ্যাটিগ সিনড্রোম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যা ডেঙ্গু রোগীদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে আসতে বাধা সৃষ্টি করে।

Dengue_

এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক সমস্যা ডেঙ্গু রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘসময় ধরে ক্লান্তি ও ব্যথায় ভোগার কারণে তাদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা এবং কাজের সক্ষমতা কমে যায় বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ২০০০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ডেঙ্গু সংক্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

২০২৩ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটিতে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্তরা প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত শারীরিক দুর্বলতায় ভুগতে পারেন। এ গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতা ডেঙ্গু রোগীদের মানসিক অবস্থাও প্রভাবিত করছে, যা কাজে ফেরা এবং দৈনন্দিন কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করছে।

 

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিলতায় যায় না। তবে ভাইরাস ইনফেকশন হওয়ায় ভালো হয়ে গেলেও পোস্ট ভাইরাল এসথেনিয়া দেখা যায়। ফলে অবসাদ, ক্লান্তি, রুচি না থাকা, দুর্বল লাগা সমস্যাগুলো দেখা দেয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে তা ভালো হয়। এ নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দুর্বলতাটা বেশি সময় থাকে। এছাড়া যারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যানসার ও স্ট্রোকের রোগীদের মতো দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভোগেন তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি হয়। কারও সুস্থ হওয়ার দীর্ঘদিন পরেও জটিলতা দেখা দিলে এ ধরনের রোগীদের অন্য সমস্যা রয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। যাদের এ ধরনের সমস্যা হয় তা এক্সেপশনাল। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।

চিকনগুনিয়া বেশি ভোগায় জানিয়ে ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা একই রকম। তবে ডেঙ্গু থেকে চিকনগুনিয়া অধিক ভোগায়। রোগীরা মারাত্মক ব্যথায় ভোগেন। এটা মাসের পর মাস থাকতে পারে। ব্যথা ছাড়া বাকি সমস্যাগুলো দ্রুত ছেড়ে দেয়। অনেকে প্যারালাইজডের মতো হয়ে যান। তবে এজন্য নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে যা চিকিৎসকরা রোগীর অবস্থা অনুযায়ী গ্রহণের পরামর্শ দেন। প্রয়োজনে ফিজিওথেরাপি নিতে হয়।

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments