ইউক্রেনের অবরুদ্ধ মারিওপোল শহরের সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য রাশিয়া বুধবার গ্রিনিচ মান সময় বেলা এগারোটা (ইউক্রেন সময় ২টা) পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। তবে এখনো পর্যন্ত কোন ইউক্রেনিয়ান সেনা আত্মসমর্পণ করেনি।
মারিওপোলের ইউক্রেনিয়ান সেনারা এখন এক বিশাল ইস্পাত কারখানার ভেতর কোণঠাসা হয়ে আছে। সেখানে তাদের সঙ্গে এক হাজারের মতো বেসামরিক নাগরিকও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সেখানে ইউক্রেনিয়ান বাহিনীর অধিনায়ক বলেছেন, তারা আর মাত্র কয়েকদিন বা কয়েক ঘণ্টা হয়তো টিকে থাকতে পারবেন।
ইউক্রেনের সরকার অবশ্য বলছে, মারিওপোল থেকে বেসামরিক মানুষদের উদ্ধারে রাশিয়ার সঙ্গে একটা সমঝোতা হয়েছে।
ইউক্রেনের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচুক ফেসবুকে লিখেছেন, নারী, শিশু এবং বয়স্ক মানুষদেরকে এই সমঝোতার আওতায় শহর ছেড়ে যেতে দেয়া হবে।
মারিওপোলের মেয়র ভাদিম বোইচেংকো জানিয়েছেন, বুধবার ৬,০০০ মানুষকে উদ্ধারের জন্য সেখানে ৯০টি বাস পাঠাবে ইউক্রেন। তিনি বলেন, প্রায় এক লাখ মানুষ এখনো শহরে আটকে আছে।
মারিওপোলে আযভস্টাল ইস্পাত কারখানা এলাকাটিই এখন ইউক্রেনীয় প্রতিরোধের সর্বশেষ ঘাঁটি। এটির পতন ঘটলে পুরো মারিওপোল রুশদের হাতে চলে যাবে।
রুশ সৈন্যরা যখন ধীরে ধীরে মারিওপোলে ঢুকতে শুরু করে, তখন এই বিশাল ইস্পাত কারখানা এলাকার দিকে সরে যায় হাজার হাজার ইউক্রেনীয় সেনা। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আযভ ব্যাটালিয়নও। ইউক্রেনের এই বিতর্কিত জাতীয় রক্ষী বাহিনী ইউনিটের সঙ্গে কট্টর ডান-পন্থী গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক আছে।
কারখানা এলাকার ভেতর মাটির নীচে বহু টানেল এবং ওয়ার্কশপ আছে, ফলে সেখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালানোর কিছু সুবিধা আছে।
বিচ্ছিন্নতাবাদী দোনেৎস্ক অঞ্চলের একজন কর্মকর্তা ইয়ান গাগিন রাশিয়ার সরকারি বার্তা সংস্থা রিয়া নোভোস্তিকে জানিয়েছেন, এই বিশাল ইস্পাত কারখানার নীচে লুকিয়ে আছে কার্যত আরেকটি শহর।
রাশিয়া এই কারখানায় আর্টিলারি এবং বিমান হামলা চালাচ্ছে। এর আগেও রাশিয়া সেখানে অবস্থান নেয়া ইউক্রেনিয়ান সেনাদের দুবার আত্মসমর্পণের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একজন উপদেষ্টা বলেছেন, রাশিয়া সেখানে ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা ফেলছে, যা মাটির নীচের আশ্রয়কেন্দ্রও ধ্বংস করে দিতে পারে।
কত ইউক্রেনীয় সেনা সেখানে আছে তা পরিষ্কার নয়। তবে বিবিসির কাছে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় স্থানীয় মেরিন কমান্ডার মেজর সেরহি ভলিয়ানা বলেছেন, ইস্পাত কারখানার ভেতর প্রায় পাঁচশো আহত সেনাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
মেজর ভলিয়ানা আরও জানিয়েছেন, তার সৈন্যদের রসদ প্রায় ফুরিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, এই ভিডিও বার্তাটিই হয়তো বিশ্বের কাছে তাদের শেষ বার্তা।
মারিওপোলের ডেপুটি মেয়রও জানিয়েছেন, ইস্পাত কারখানায় খাদ্য, পানি এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী প্রায় শেষ হয়ে গেছে।
সের্গেই ওরলভ বিবিসিকে জানান, ‘তাদের প্রায় কিছুই নেই। পানি, খাদ্য, ওষুধ, কিছুই নেই। রুশরা সেখানে কিছুই পাঠাতে দিচ্ছে না। কোন মানবিক ত্রাণ পাঠাতে দিচ্ছে না, কোন উদ্ধার অভিযানও চালাতে দিচ্ছে না’।
রুশ বোমা বর্ষণে মারিওপোল শহর প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, রাশিয়া ইউক্রেনে ৭৬টি ট্যাকটিক্যাল ব্যাটালিয়ন গ্রুপ পাঠিয়েছে, তার প্রায় ১২টি এখন মারিওপোলে যুদ্ধ করছে। যদি মারিওপোলের পতন ঘটে, তখন সেখান থেকে রাশিয়া তাদের ১০,০০০ সৈন্যকে ডনবাস অঞ্চলের অন্যান্য জায়গায় লড়াইয়ের জন্য পাঠাতে পারবে।
মারিওপোল দখল করতে পারলে রাশিয়া তাদের দখলে থাকা ক্রিমিয়া অঞ্চলকে রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা পূর্ব ইউক্রেনের এলাকাগুলোর সঙ্গে যুক্ত করতে পারবে। এর ফলে ইউক্রেনের কৃষ্ণ সাগর উপকূলের ৮০ শতাংশই আসলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। ইউক্রেন তখন কার্যত বাকী বিশ্ব থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সমুদ্র পথে তাদের বাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।
এটিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন একটি বড় বিজয় হিসেবে দেখিয়ে প্রোপাগান্ডা চালাতে পারবেন।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া এ পর্যন্ত একটি মাত্র বড় শহর, খারসন দখল করতে পেরেছে। মারিওপোল দখল করতে পারলে প্রেসিডেন্ট পুতিন তার দেশের জনগণকে দেখাতে পারবেন যে রাশিয়া যে লক্ষ্য নিয়ে সেখানে গেছে, তা অর্জিত হচ্ছে।
অন্যদিকে আযভ ব্যাটালিয়নকে ধরতে পারলে প্রেসিডেন্ট পুতিন দাবি করতে পারবেন যে, ইউক্রেনিয়ান সরকার নাৎসিদের হাতে চলে গেছে, যেরকম একটা ভিত্তিহীন দাবি তিনি অনেকদিন ধরেই করে যাচ্ছেন।