‘‘সেদিন ছিল মঙ্গলবার। ২০ বছর আগে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। রোজকার মতো সেদিনও আমি সকাল ৯টার আগেই কর্মক্ষেত্রে পৌঁছে গিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের সাবওয়ে স্টেশন থেকে জাতিসংঘের সদর দপ্তর হাঁটাপথে পাঁচ-সাত মিনিট। ব্যতিক্রমী কিছুই নজরে আসেনি, কিন্তু ৪২ স্ট্রিটের মূল ফটকে আসতেই থমকে গেলাম। দরজা বন্ধ, অনেক লোক গেটের বাইরে জটলা করছে। শুনলাম, মাত্র কয়েক মিনিট আগে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ার একটি বিমান দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। তাকিয়ে দেখি, দূরের আকাশে ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডুলি পাকিয়ে উঠছে। ঠিক কী হয়েছে কেউ জানে না, বুঝতেও পারছে না। মুহূর্ত পরেই দেখি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দ্বিতীয় টাওয়ারে আরেকটি বিমান আছড়ে পড়ল। কোনো সন্দেহ থাকল না, দুর্ঘটনা নয়, এটি ইচ্ছাকৃত সন্ত্রাসী হামলা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ওই সন্ত্রাসী হামলা ইতিহাসে ‘নাইন-ইলেভেন হামলা’ নামে ঠাঁই করে নিয়েছে’’।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনার বিবরণ এভাবেই দিয়েছেন এক প্রত্যক্ষদর্শী।
এক বাংলাদেশি বলেন, ‘অফিস বন্ধ হয়ে গেল। আরও সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে; এই আশঙ্কায় সাবওয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো। শহর থেকে বেরুনোর টানেলও বন্ধ। চারদিকে আতঙ্ক, চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা। ইস্ট রিভারের অপর পারে কুইন্সে আমার বাড়ি, সেখানে কী হচ্ছে জানার উপায় নেই। তখনো হাতে হাতে সেলফোন আসেনি। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে হাঁটা পথে ফিরে চললাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পালানো মানুষের কাফেলা দেখেছি। কিন্তু এত মানুষ, এত বিভিন্ন দেশের মানুষ একই সন্ত্রাসের শিকার হয়ে এভাবে প্রস্থান করছে, সে দৃশ্য আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না।’
যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে ওই সন্ত্রাসী হামলার বিশ বছর শনিবার। ওই হামলার জেরে গত বিশ বছর ধরে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এত বছরেও নাইন-ইলেভেনের ক্ষত সারেনি যুক্তরাষ্ট্রে। এখনো প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা নাইন ইলেভেনের ভয়ার্ত স্মৃতির চাপে রয়েছে। অপরদিকে ঠিক ২০ বছরেই আফগানিস্তানে আবার ক্ষমতায় এসেছে তালেবান।
টুইন টাওয়ারের হামলায় প্রায় ৬০ দেশের ২ হাজার ৭৪৯ মানুষ নিহত হন। এদের মধ্যে ১২ জন বাংলাদেশিও ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটি চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, এ ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত যুদ্ধে নিহত হয়েছে নয় লাখ মানুষ। খরচ হয়েছে আট ট্রিলিয়ন ডলার। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট জঙ্গি হামলা ও তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে যে প্রাণহানী ঘটেছে, সেগুলোও ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণায় যুক্ত করা হয়েছে। সে হিসাবে বিশ্বের ৮০ দেশে ছড়িয়ে পড়া এ যুদ্ধের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ফ্র্যাংক গার্ডনার শুক্রবার লিখেছেন, ‘‘নাইন ইলেভেনের হামলা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে এ যাবতকালের সবচেয়ে ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা। এ ঘটনার পর যখন দেশটি বিরাট এক ধাক্কা খেয়েছে, তখন অনেকেই বাকি বিশ্বকে দেখা শুরু করলেন একেবারে মোটা দাগের বিচারে- ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত, ভালো লোক আর খারাপ লোক’’।
নাইন ইলেভেনের হামলার ঠিক নয় দিন পর প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ঘোষণা করলেন, ‘প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক অঞ্চলকে এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনারা হয় আমাদের সঙ্গে আছেন, অথবা আপনারা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আছেন’।
ফ্র্যাংক গার্ডনার লেখেন, এরপর তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ ঘোষণা করা হলো। এই ঘোষণার পর প্রথমে আফগানিস্তান এবং তারপর ইরাকে আক্রমণ চালানো হলো। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর উত্থান ঘটলো। ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের বিস্তার ঘটলো। হাজার হাজার সৈনিক এবং তার চেয়ে আরও বহু গুণ বেসামরিক মানুষ নিহত হলো। সন্ত্রাসবাদ নির্মূল হয়নি- বরং ইউরোপের প্রায় প্রত্যেকটি বড় দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে। তবে কিছু সাফল্যও আছে। এখনো পর্যন্ত নাইন ইলেভেনের সঙ্গে তুলনীয় ভয়ংকর কোনো হামলা হয়নি। আফগানিস্তানে আল-কায়েদার ঘাঁটি ধ্বংস হয়েছে। তাদের নেতাকে (ওসামা বিন লাদেন) পাকিস্তানে খুঁজে বের করে হত্যা করা হয়েছে। আইসিস সিরিয়া এবং ইরাকের একটা বিরাট অঞ্চলে স্বঘোষিত খেলাফতের মাধ্যমে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
আল–কায়েদার বিরুদ্ধে ওই হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। সংগঠনটির নেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয়দানের অভিযোগে ও হামলার প্রতিশোধ নিতে আফগানিস্তানে ২০০১ সালেই কথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে নেয় তার মিত্র দেশগুলোকে। এরপর থেকে গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র অনেকবার তার এ একতরফা যুদ্ধের লক্ষ্য পাল্টেছে; সঙ্গে পাল্টেছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর হামলার হুমকির মাত্রা ও পরিসর।
প্রেসিডেন্ট বুশের ওই ভাষণের ২০ বছর পর দেখা গেল, ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধে লাখ লাখ নিরীহ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছেন। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে হাজার হাজার কোটি ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বেড়ে ওঠার সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তারা সতর্ক করে বলেন, ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর পিছুহটা ও দেশটিতে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মার্কিনবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে আরও সংগঠিত ও বিস্তৃত হওয়ার সক্ষমতা প্রদান করতে পারে; যা অনেক বছর ধরে পায়নি তারা।