Sunday, April 28, 2024
HomeScrollingতালেবান সরকার কোন পথে যাচ্ছে

তালেবান সরকার কোন পথে যাচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক।।

গত ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর থেকে বেশ কিছুদিন ধরেই তালেবান নেতারা বলে আসছিলেন যে, ‘আমরা এমন একটি সরকার গঠন করার চেষ্টা করছি যাতে আফগানিস্তানের সকল জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকবে’। তালেবান নেতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারও একই কথা বলেছিলেন।

তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ্ মুজাহিদ বলেছিলেন, ‘আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই’। ঝড়ের গতিতে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর গত ১৫ই অগাস্ট কাবুলে তালেবানের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমরা দেশের ভেতরে বা বাইরে কোন শত্রু চাই না’।

অন্যদিকে, তালেবানের ওপর নজর রাখছে যেসব বিদেশি সরকার এবং বিশ্বব্যাপী যে আফগান বিশেষজ্ঞরা আছেন, তাদের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছে, ‘তালেবানদেরকে তাদের কথা দিয়ে নয়, বরং কাজ দিয়েই মূল্যায়ন করতে হবে’।

কিন্তু সম্ভবত সবচেয়ে গভীরভাবে নজর রাখছে আফগান নাগরিকরা নিজেরা। কারণ এছাড়া তাদের কোনো উপায় নেই।

কিন্তু যেদিন কাবুলসহ অন্যান্য শহরে আফগান নারীরা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার নিয়ে তাদের অধিকার, সরকার ও সমাজে তাদের বড় ভূমিকার দাবিতে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করলেন, তখনই দেখা গেল তালেবানের নতুন সরকারের আসল রূপ।

এটাই কি মিডিয়া সচেতন তালেবান? বিক্ষোভ ভেঙে দিতে তারা যে ফাঁকা গুলি ছুঁড়েছে, রাইফেলের বাট আর লাঠি দিয়ে বিক্ষোভকারীদের পিটুনি দিয়েছে সেটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য তারা আয়োজন করেছে এক অনাড়ম্বর সংবাদ সম্মেলনের। সোশাল মিডিয়ায় এটা নিয়ে প্রবল আগ্রহ শুরু হলেও তারা যে কথাটি বলেছে তাতে তালেবানের প্রতিশ্রুতির ওপর এখনও ভরসা করে আছেন যারা তাদের হৃদয় ভেঙে গেছে।

তালেবানের নতুন সংস্করণ কতটা নতুন

তালেবান সবাইকে নিয়ে সরকার গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটা একেবারেই হয়নি। তালেবানের নেতৃত্বে পুরনো কাঠামো, এর নানা ধরনের কমিশন, ডেপুটি এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আমির হেবাতুল্লাহ্ আখুনজাদা- এদের সবাইকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে মন্ত্রিসভার কাঠামোর মধ্যে, যেমনটি অন্য দেশের সরকারের রাজনৈতিক কাঠামোতেও দেখা যায়।

পুরনো তালেবান সরকারের নৈতিকতা সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়টি পুনর্বহাল করা হয়েছে। মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাদ দেয়া হয়েছে। সরকারের সদস্যরা বেশিরভাগই পশতু জাতিগোষ্ঠীর সদস্য। মন্ত্রিসভায় রয়েছেন একজন তাজিক এবং একজন হাজারা- তারা দুজনেই তালেবানের সদস্য। একজন নারীকেও মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়নি। এমনকি উপমন্ত্রীর মর্যাদায়ও কোন নারী নেই।

তালেবানের এই নতুন সরকার গঠিত হয়েছে পুরনো তালেবান নেতা এবং নতুন প্রজন্মের মুল্লাহ্ ও সামরিক অধিনায়কদের নিয়ে। ১৯৯০য-র দশকে যারা তালেবানের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারাই ফিরে এসেছেন। তাদের দাড়ির রঙ এখন সাদা, দাড়ির দৈর্ঘ্যও বেড়েছে। সরকারে রয়েছে গুয়ানতানামো বে থেকে ফিরে আসা কিছু সদস্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত কয়েকজন সদস্যও রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে তীব্র লড়াইয়ে যুক্ত ছিলেন এমন ক‌য়েকজন অধিনায়ক, আর কিছু স্বঘোষিত শান্তি আলোচনাকারী, যারা নানা দেশে চক্কর দিয়ে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে এটি তালেবানের নতুন সংস্করণ।

শান্তির ডাক

তালেবানের কেয়ারটেকার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি। তার ছবি খুঁজে পাওয়া বিরল। শুধু মার্কিন তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের একটি পোস্টারে তার চেহারা দেখা যায়, যেখানে খয়েরি চাদরে তার মুখ অর্ধেক ঢাকা। এফবিআই তার মাথার দাম ধরেছে ৫০ লক্ষ ডলার।

কিন্তু তিনি সম্প্রতি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২০২০ সালে একটি নিবন্ধ লিখে। এই নিবন্ধে তিনি শান্তির ডাক দেন। তবে এতে তিনি বলেননি যে হাক্কানি নেটওয়ার্ক নামটি তার পরিবারের কাছ থেকে এসেছে, এবং আফগান বেসামরিক জনগণের ওপর কিছু নৃশংস হামলার জন্য এই গোষ্ঠীকেই দায়ী করা হয়। হাক্কানি পরিবার জোর দিয়ে বলে যে তাদের কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নেই, এবং তারা এখন তালেবানের সদস্য।

তালেবানের কেয়ারটেকার সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছেন মোল্লাহ্ ইয়াকুব। তার কোন ছবি নেই। মন্ত্রিসভার তালিকায় তার ছবির জায়গায় রয়েছে ফাঁকা ঘর। তিনি তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা আমির মোল্লাহ্ ওমরের বড় ছেলে।

কিন্তু এটা শুধু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কাবুলের সংবাদ সম্মেলনে যখন সাংবাদিকরা ঝাঁকে ঝাঁকে প্রশ্ন ছুঁড়তে শুরু করেন, তখন জানানো হয় যে আগামীতে মন্ত্রিসভার আরও নাম ঘোষণা করা হবে। তালেবানের সংস্কৃতি বিষয়ক কমিশনের উপপ্রধান আহমাদুল্লাহ ওয়াসেক বিবিসিকে জানান, ‘আমরা সবগুলো মন্ত্রণালয়ের এবং ডেপুটিদের নাম এখনই ঘোষণা করতে যাচ্ছি না। এমনও হতে পারে যে এই তালিকা আরও বড় হবে’।

এটা হতে পারে তালেবানের নেতা ও যোদ্ধাদের পুরষ্কার দেয়ার প্রাথমিক ধাপ। এদের মধ্যে অনেকেই দল বেধে কাবুলে এসে হাজির হচ্ছেন একটি ‘খাঁটি ইসলামী ব্যবস্থা’র প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানানোর জন্য।

এই সরকারকে সযত্নে গড়া একটি আপোষ মীমাংসা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। হঠাৎ করেই মুল্লাহ্ আখুন্দের নাম একেবারে শীর্ষে উঠে এসেছে। এক ধাক্কায় তিনি হটিয়ে দিয়েছেন রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতাদের। অনেকের ধারণা ছিল মোল্লাহ্ বারাদরই হবেন শীর্ষ নেতা। কিন্তু তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে।

তালেবান নেতারা একই সঙ্গে বাদ দিয়েছেন অতীতের কিছু রাজনৈতিক নেতাকে, বিশেষভাবে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। এদের ক্ষেত্রে তালেবানের যুক্তি হচ্ছে এরা একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন।

‘সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন’

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তালেবানের ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তির পর তালেবান পক্ষের আলোচনাকারী শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাইকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যেসব আফগান নাগরিক তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসায় শঙ্কিত, তাদের প্রতি তিনি কী বলবেন? জবাবে তিনি জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমি তাদেরকে বলব আমরা এমন এক সরকার গঠন করব যা সংখ্যাগরিষ্ঠ আফগানের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে’। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ শব্দটির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এর মানে হলো এই সরকার গঠিত হবে ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের ভিত্তিতে, তারা যাকে পশ্চিমা ধারণা বলে উপহাস করে তার ভিত্তিতে নয়।

সেটা ছিল এমন এক সময় যখন আফগানরা স্বপ্ন দেখতেন যে যুদ্ধের শোচনীয় পর্যায়টি তারা পার করে এসেছেন। ওই বছরেরই পরের দিকে পারস্য উপসাগরের দেশ কাতারে আফগানিস্তান নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রথম দিনে তালেবান প্রতিনিধিদের একটা কথা নিয়ে জোর আলোচনা চলছিল। তারা ইঙ্গিত করেছিলেন যে তারা আফগানিস্তানে ইসলামি আমিরাত প্রতিষ্ঠা করবেন না। কারণ, তার বলেছিলেন, এই বিষয়টি নিয়ে স্পর্শকাতরতা রয়েছে সেটা তারা উপলব্ধি করেন।

নারী আলোচনাকারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা আশ্বস্ত করেছিলেন যে একমাত্র প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়া যে কোন পদে নারীদের ভূমিকা থাকবে। এমনকি মন্ত্রী পদেও।

‘আফগানিস্তানের সামাজিক বুনন সম্পর্কে যারা জানেন না তারা গুরুতর চ্যালেঞ্জর মুখোমুখি হবে,’ বলেছিলেন সাবেক এমপি ফওজিয়া কুফি, যিনি এ ধরনের প্রতিশ্রুতি অতীতে বহুবার শুনেছেন।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে প্রশ্ন

এই চ্যালেঞ্জ এখন আফগানিস্তানের পথে পথে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সারা বিশ্বের রাজধানীগুলো থেকেও এই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে।

‘সারা বিশ্ব গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য রাখছে,’ বলে এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর। ‘তালেবান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খুব শিগগিরই স্বীকৃতি পাবে, এমন সম্ভাবনা কম,’ মতামত দিয়েছে রাশিয়ার নেজাভিসিমিয়া গাজেটা পত্রিকার এক সম্পাদকীয়।

তালেবানের তরুণ প্রজন্ম থেকেও চ্যালেঞ্জ উঠে আসছে

সম্প্রতি এক তরুণ তালেবের সঙ্গে কথা বলার সময় বিবিসিকে তিনি বলেছিলেন, ‘ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে’। তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, তালেবান কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইলে, ২০০১ সালের পূর্ববর্তী তালেবান সরকারের মতোই আবার তারা ক্ষমতাচ্যুত হবে। তালেবানের সরকার নিয়ে আরেকটা অস্বস্তির কারণ হলো শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছেন এমন অনেক নেতাকে নানা ধরনের পদ দেওয়া হয়েছে।

কেয়ারটেকার কেবিনেট ঘোষণার পর পরই একটি বিবৃতি জারি করা হয়েছে যেখানে নতুন আমির বলেছেন, ‘মেধা, নির্দেশনা এবং কাজের জন্য সকল মেধাবী ও পেশাদার লোকদের প্রয়োজন রয়েছে’।

কিন্তু এটা পরিষ্কার যে তার বক্তব্যের মূল বিষয় হচ্ছে ‘সিস্টেম’কে জোরদার করা, অর্থাৎ ইসলামি আমিরাত পুনঃ-প্রতিষ্ঠা করা। বাদবাকি সবকিছুর চেয়ে এটার দাবি অগ্রগণ্য।

গত কয়েক দিন কাবুলে তালেবানের কর্মকাণ্ডের ওপর যারা নজর রাখছেন তাদের কয়েকজনকে বিবিসি জিজ্ঞেস করেছিল, সময়ের সঙ্গে তালেবানের নেতৃত্ব কী আরও কঠোর লাইনে যাবে, নাকি তারা আরও বেশি উন্মুক্ত হবে। শক্তিশালী ঝোড়ো হাওয়া যে কোন সময়ে তাদের গতিপথ বদলে দিতে পারে।

বিশ্বের প্রধান ত্রাণ সংস্থাগুলো, আগের সরকারের বাজেটের ৮০% যাদের অর্থ থেকে এসেছে, তারাও বিষয়টার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখছে।

‘তাদের অবস্থা একেবারে নাজেহাল,’ বলছিলেন জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ বিভাগের প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস। তিনি সম্প্রতি কাবুল সফরে গিয়ে মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি সরকারে নারীদের যুক্ত রাখার কথাও বলেছেন। তিনি বিবিসিকে জানান, তালেবানের শীর্ষ নেতারা তাকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন, এবং তাদের সদুপদেশ দিতে অনুরোধ করেছেন।

সারা বিশ্বের জিহাদি আন্দোলন, যারা ইসলামি শরিয়া মোতাবেক গঠিত ইসলামি সরকারের গঠনকে স্বাগত জানিয়েছে, তারাও কিন্তু তালেবানের নতুন নেতাদের মাইক্রোস্কোপের নীচে রেখে লক্ষ্য করছে। আফগানিস্তানে তাদের এই পরীক্ষা ব্যর্থ হলে চলবে না।

সন্ত্রাসবাদীদের অভয়ারণ্য, মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ এবং গভীর অর্থনৈতিক সংকট- তালেবানের নতুন সরকারের সঙ্গে যারা কাজ করার চেষ্টা করছেন তাদের মাথায় এসব দুর্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, নতুন সরকার চেষ্টা করছে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু সামনের এক ভিন্ন ধরনের ভবিষ্যতের চেয়েও তারা এখনো ডুবে রয়েছে অতীতে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে মন্ত্রটা ঠিকই বজায় থাকবে- কথা নয় কাজে জানা যাবে তাদের পরিচয়।

বিবিসি বাংলা

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments