ঢাকায় কয়েকদিন ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়েও বৃষ্টির দেখা পেলাম না। কিন্তু বুধবার কানের পালে দ্যা ফেস্টিভ্যাল ভবনের সামনে যেতেই ভিজতে হলো বৃষ্টিতে। কয়েকজনকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছাতা বিক্রি করতেও দেখলাম। দামটা খুব বেশি না। কিন্তু এই দেশের প্রেক্ষাপটে ডেকে ডেকে ছাতা বিক্রির বিষয়টি নতুন মনে হয়েছে।
অবশ্য যারা ডাকছেন তারা এই দেশের স্থায়ী নাগরিক কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে? দেখে মনে হয়েছে আফ্রিকান। রুগ্ন কালো চেহারা। সাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে যারা এই দেশে প্রবেশ করেন তাঁদেরই হয়তো কোনো উপায় না পেয়ে এই পেশা বেছে নিতে হয়। বিষয়টি এই কারণে উল্লেখ করলাম যে, শ্রেণী বৈষম্যের বিশ্বে লোভে পড়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে দাস বানালে পরিণতি খুব একটা ভালো হয় না।
বর্ণ বৈষম্য নিয়ে প্রতিবারেই কান উৎসবে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ দেখা যায়। বিশ্বের আর কোনো চলচ্চিত্র উৎসবে এমনভাবে এসব নিয়ে কথা বলা হয় না। অবশ্য কানেও আছে অন্ধকার, বৈষম্য। পরিচয় শনাক্তকারী কার্ডে বিভিন্ন রং দিয়ে এই ভেদাভেদ তৈরি করা হয়। যেমন ফটোগ্রাফারদের জন্য ধূসর, কমলা এবং কালো ব্যাজ দিয়ে তাদের অবস্থান বুঝানো হয়। আবার রিপোর্টারদের ক্ষেত্রে যদি কাউকে হলুদ ব্যাজ দেওয়া হয়, তাহলে বুঝতে হবে তাকে ক্রীতদাসের সাথে তুলনা করা হয়েছে। নীল ব্যাজ ইঙ্গিত করে যে আপনি শ্রমজীবী শ্রেণীর, গোলাপী হল মধ্যবিত্ত, এটি শালীন র্যাঙ্কিং যা আপনাকে আপনার নিজস্ব বিশেষ সারিতে অপেক্ষা করতে দেয় যা আগের দুটির তুলনায় অনেক দ্রুত চলে যেতে পারবেন। এরপর যে ব্যাজটি সবচেয়ে সম্মানজনক সেটি হলে হলুদের মধ্যে সবুজ রঙের বিন্দু। এটি একটি লোভনীয় র্যাঙ্ক যা আপনাকে প্রায় সব কিছুতে বিনামূল্যে এবং সহজে প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। এছাড়াও আছে সাদা রঙের একটি বিশেষ কার্ড। এটি অনুমতি ছাড়াই সব জায়গায় যাওয়ার স্বীকৃতি দেয়।
মঙ্গলবার ও বুধবার দুইদিন পালে দ্যা ফেস্টিভাল ভববনের সামনে কার্ডধারীদের লম্বা সারি দেখে বিষয়টি প্রথমে নজরে আসে। ভুক্তভোগী ফিনল্যান্ডের একজন সাংবাদিক বলেছেন, কানের মতো এতো বড় উৎসবে পরিচয়পত্রের রং দিয়ে বৈষম্য তৈরী করা মোটেও ঠিক হয়নি।
অবশ্য কান কর্তৃপক্ষ মনে হয় ইচ্ছা করেই এমনটি করছে। কারণ তারা অতীতেও বিতর্কিত অনেক বিষয় হঠাৎ করে সামনে নিয়ে এসেছে। এবার যেমন নিয়ে এসেছে জনি ডেপকে। গত কয়েক বছরে নায়ক থেকে খলনায়কে পরিণত হয়েছিলেন হলিউড অভিনেতা জনি ডেপ। স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশের কাছে যাওয়ার পর থেকেই তার এই নেতিবাচক চরিত্র সামনে আসে। এরপর থেকে গত তিন বছর সিনেমা থেকে দূরে ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত মামলার রায় তার পক্ষে গেলেও সমালোচনা কমেনি। এ কারণেই বোধহয় মঙ্গলবার জনি ডেপের কানে আশা নিয়ে সমালোচনা করেছেন অনেকে। কেউ কেউ বলেছেন জনি ডেপকে কানে ডেকে এনে একটি অপরাধকে (স্ত্রীকে নির্যাতন) সমর্থন দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য ৭৬তম কান চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ এসব নিয়ে ভাবছে না। আসরের উদ্বোধনী ছবিটিই ছিল জনি ডেপের। নাম ‘জান দ্যু ব্যারি’। পরিচালনা করেছেন মাইওয়েন। সিনেমাটি প্রর্দশনের পর টানা সাত মিনিট করতালি দিয়ে ছবির কলাকৌশলীদের সম্মান জানিয়েছেন দর্শক। অনেকেই বলেছেন তিন বছর ধরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন জনি তার ফলাফল হচ্ছে ওই করতালি।
সংবাদ সম্মেলনে এসে জনি ডেপ বিষয়টি নিয়ে মজা করে বলেছেন যে, ‘আমি তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভয়ই পেয়ে গিয়ে ছিলাম।’ পরে অবশ্য তিনি বলেছেন, ‘এ ধরণের কাজ ভালো কাজে উৎসাহ বাড়ায়।’
মূহুর্তের মধ্যে দুই রকম কথাই প্রমাণ করে এই অভিনেতার মধ্যে রসবোধ আছে। আবার সিরিয়াস প্রতিক্রিয়া দিতেও ভুলেন না। অর্থাৎ তিনি পর্দা ও বাস্তবে বিশ্ব-সেলুলয়েডের জীবন্ত এক স্যাটায়ার বক্স! ফলে কান সৈকতে সংবাদ সম্মেলনে এসেও সাংবাদিকদের নিয়ে রসিকতা করতে ছাড়লেন না তিনি।
প্রাক্তন স্ত্রী অ্যাম্বার হার্ডের বিপক্ষে মানহানির মামলায় আইনি লড়াইয়ে জেতার পর এটাই তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। এভাবেও বলা যায়, হলিউড থেকে দূরে সরে গিয়ে লম্বা বিরতির পর প্রধান চরিত্রে ফের পর্দায় ফিরেছেন তিনি। ফরাসি নির্মাতা-সহশিল্পীদের নিয়ে তার প্রত্যাবর্তন হলো।
এটা সত্যি যে অ্যাম্বার হার্ডের সঙ্গে মামলার রেশ ধরে এবং হলিউড থেকে কাজ হারানো বিষয়ক গুঞ্জনের আগুনে গণমাধ্যমের ‘ঘি’ ঢালার বিষয়টি নিয়ে জনি ডেপ তেঁতে আছেন এখনও! এক প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি সার্কাস হলেও এটুকু তো ঠিক যে, আমরা একটা সিনেমা বানিয়েছি বলেই অভিজ্ঞতা শেয়ারের জন্য এখানে এসেছি। তাই কেউ ভাববেন না, আমরা পণ্য বিক্রির জন্য এসেছি।’
গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ববাসী তার সম্পর্কে যেসব সংবাদ জেনেছেন, সেসব নিয়ে জনি বলেন, ‘গত পাঁচ-ছয় বছরে আপনারা সংবাদমাধ্যমে আমার সম্পর্কে যা যা পড়েছেন কিংবা লিখেছেন, সেসবের বেশিরভাগই ছিল ভয়ঙ্কর সব কল্পকাহিনি।’
জনি ডেপ নতুন সিনেমায় পঞ্চদশ ফরাসী রাজার চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এ সম্পর্কে নির্মাতা মাইওয়েনের কাছে প্রশ্ন ছিল, একজন আমেরিকান অভিনেতাকে কেন ডেকে এনে ফরাসি রাজার চরিত্রে অভিনয় করাতে হলো! তার জবাব, ‘প্রথমে অনেক ফরাসি অভিনেতার সঙ্গে চরিত্রটি নিয়ে আলাপ করেছি। কিন্তু আমি যা চাইছিলাম, সেটি মেলাতে পারছিলাম না কিছুতেই। এরপর চিত্রনাট্য নিয়ে জনি ডেপের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমার মনে হলো, এই চরিত্রে শুধু তিনিই জুতসই হতে পারেন। এরপর আলাপ করে এবং শুটিংয়ে গিয়ে সত্যিই তার ভালোবাসায় ডুবে গেছি। তিনি অসাধারণ একজন অভিনেতা।’
নির্মাতা ও সহশিল্পীদের এমন আলাপের ২৭ মিনিটের মাথায় সংবাদ সম্মেলনে ঢোকেন জনি ডেপ। যেন প্রাণ ফিরে আসে পুরো হলরুমে। শুরু হয় সাংবাদিকদের প্রশ্ন।
হলিউডকে বিদায় জানিয়েছেন কিংবা বয়কট করেছেন জনি ডেপ, এমন চর্চা বেশ ক’বছর ধরে চলছে। কারণ শেষ তিন বছরে হলিউডের একটি কাজও করেননি তিনি। সেই প্রশ্নই এবার তাকে সরাসরি পেয়ে উঠে এলো। জবাবে জনি ডেপ বললেন, ‘আপনারা কেউ বলছেন, আমি অভিনয় থেকে রিজাইন দিয়েছি। কেউ বলছেন, হলিউডকে বয়কট করেছি। বিষয়টি আসলে এমন নয়। এগুলো বাতাসে ওড়া খবর। যার কোনও সত্যতা বা বাস্তবতা নেই। হলিউডকে আমার বয়কটের প্রশ্নই আসে না। কারণ আমি হলিউড নিয়ে ভাবিই না। আমি যা করেছি হলিউডে, এর বেশি প্রয়োজনও নেই।’
প্রাক্তন স্ত্রীর বিপক্ষে আইনি লড়াইয়ে জেতার পর বড় পর্দায় জনি ডেপের ফেরাকে ‘কামব্যাক’ হিসেবে অভিহিত করে আসছে গোটা বিশ্বের গণমাধ্যম। এই শব্দ নিয়ে জনি জানালেন তীর্যক মন্তব্য, ‘এভাবে যদি আপনারা হিসাব করেন, তাহলে এ পর্যন্ত অন্তত ১৭ বার কামব্যাক করেছি!’
সেইসঙ্গে যোগ করেন, ‘আমি খুবই বিস্মিত হই, যখন এই কামব্যাক শব্দটি শুনি। কারণ, আমি তো কোথাও চলে যাইনি। আগামীতেও যাব না। সবসময় সবার চারপাশেই ছিলাম, এখনও আছি।’
Leave a Reply