Wednesday, May 8, 2024
HomeScrollingবারবার ভূমিকম্প, কোথায় ঝুঁকি কতটা, ইতিহাস কী বলছে?

বারবার ভূমিকম্প, কোথায় ঝুঁকি কতটা, ইতিহাস কী বলছে?

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আবারও ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এনিয়ে চলতি মাসে মোট তিনবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, রোববার দুপুরে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ২। যার উৎপত্তিস্থল ছিল টাঙ্গাইলের একটি এলাকায়, অর্থাৎ ঢাকা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে।

যদিও বাংলাদেশ এবং ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইল। কিন্তু মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের মতে, এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ঘোড়াশাল এলাকায়।

তবে উৎপত্তিস্থল টাঙ্গাইল কিংবা নরসিংদী— যেখানেই হোক-দুটি জায়গায় ঢাকার খুব কাছে।

অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। তিনি ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বলছেন, ভূমিকম্পের সম্ভাব্য দুটি উৎসই ঢাকার দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে। এছাড়া ঢাকার পাশ্ববর্তী কয়েকটি এলাকায় ভূমিকম্পের ইতিহাসও আছে।

তিনি মনে করেন, বিশেষ করে সিলেট এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সেটাই হবে ঢাকার জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ।

ঢাকার আশপাশে ভূমিকম্প নতুন নয়
মাঝে মাঝে ঢাকার আশপাশে অনুভূত হওয়া ভূকম্পনগুলোর উৎস সাধারণত বাংলাদেশের বাইরের, ঢাকা থেকে ২ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে। অনেকগুলো ভূমিকম্পের মূল কেন্দ্র ছিল পূর্ব দিকে মিয়ানমার অথবা ভারতের মিজোরাম, মনিপুর এবং উত্তরে আসাম, নেপাল কিংবা ভুটানে। কিন্তু এর মধ্যেই অনেক ছোট-বড় ভূমিকম্প হয়েছে যার উৎসস্থল ছিল ঢাকার কাছাকাছি এলাকাগুলোতে।

অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, গেল ১৫/২০ বছরে নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ১।

এছাড়া ফরিদপুর থেকেই গত দেড় দশকের মধ্যে অন্তত দুবার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তিন বছর আগে, অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের ১২ কিলোমিটার পূর্বে ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। আর্থকোয়েকট্র্যাক বলছে, ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলের নাগরপুরে এবং ২০১৯ সালে মির্জাপুরে ৪ মাত্রার নিচে ভূমিকম্প হয়েছে।

ঢাকার দোহার থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে চলতি বছরের মে মাসেই ৪ দশমিক ৩ মাত্রা ভূমিকম্প উৎপত্তি হয়েছিল। গবেষকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এই ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি ছিল। জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৮ মার্চ ৪ দশমিক ৫ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল একই স্থানে।

অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্ট ভূমিকম্পের একটি উৎস। ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল বিশেষ করে মধুপুর গড়ের লালমাটি থেকে যমুনার পললভূমি- যেটা ঢাকার কাছে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত, পুরো ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই ফল্ট। এছাড়া গত মাসে যে দুটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল সেগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট অঞ্চলের সীমান্ত এলাকা।

কোথায় কতটা ঝুঁকি, ঢাকার কত কাছে
বিশেষজ্ঞদের মতে— পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা আলাদা বিট বা প্লেট টেকটোনিক দিয়ে তৈরি। যা নিচের নরম পদার্থের ওপরে ভাসছে। সারা পৃথিবীতে এরকম বড় সাতটি প্লেট এবং অসংখ্য ছোট ছোট সাব-প্লেট রয়েছে। এগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে বা একটি অন্যটিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন ভূ-তত্ত্বের মাঝে ইলাস্টিক এনার্জি শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে। সেটা যখন শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন সেই শক্তি কোনো বিদ্যমান বা নতুন ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। তখন ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন তৈরি হয়, সেটাই হচ্ছে ভূমিকম্প।

এছাড়া যেসব জায়গায় একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ একটি গবেষণা করেছিল। গবেষণা অনুযায়ী, সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অঞ্চল, দুটো প্লেটের সংযোগস্থল।

এখানে একটি প্লেট আরেকটার নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। সেটি হলো, ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সুনামগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জের হাওড় ও মেঘনা নদী হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বরাবর ওই প্লেটটি তলিয়ে যাচ্ছে।

ঢাবির সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, গবেষণা বলছে এই সাবডাকশান জোনই হলো ভূমিকম্পের উৎসস্থল। আমাদের গবেষণা দেখা গেছে, এই সাবডাকশান জোনে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চয় হয়ে আছে তার মাত্রা ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রা পর্যন্ত। সাধারণত বড় ধরনের ভূমিকম্পগুলো এমন জোনেই হয়। যেটা চিলি, আলাস্কা বা জাপানেও দেখা যায়।

ডাউকি ফল্ট— এটি বাংলাদেশ অঞ্চলের আরেকটি ভূমিকম্পের উৎস। শেরপুর থেকে শুরু জাফলং হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ থেকে বিস্তৃত এই ফল্ট। বিশেষ করে এর পশ্চিমাংশ আরেকটা ভূমিকম্পের উৎস।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বাংলাদেশকে ঘিরে ভূমিকম্পের এ দুটি উৎস কাছাকাছি হলেও সাবডাকশান জোনটিই হলো ভয়ংকর। এগুলো ঢাকা থেকে ৭০-১৫০ কিলোমিটার দূরে। ফলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে সেটাতেই ঢাকার অবস্থা খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।

কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। এখানকার ভবনগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতা অনেক বেশি। কারণ শহরটি গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত উপায়ে। সরকারের প্রস্তুতি ও জনসচেতনতার অভাবও রয়েছে প্রকট। অর্থাৎ ঝুঁকির তীব্রতা বাড়াতে যা যা দরকার সবই ঢাকায় বিদ্যমান। এ কারণেই মনে হচ্ছে ভূমিকম্পগুলো ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে।

কত বছর পরপর হয় ভূমিকম্প
গবেষণায় দেখা গেছে, সাবডাকশন জোনে বড় আকারের দুটি ভূমিকম্পের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান হচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ বছর। ময়নামতি পাহাড়ে বৌদ্ধ বিহারের যে স্থাপনা ওই এলাকা থেকে লোকজন অভিবাসন করে চলে গেছে ৮০০ থেকে ১ হাজার বছর আগে। তাদের এই অভিবাসনের সঙ্গে ভূমিকম্পের সম্পর্ক ছিল।

ভূমিকম্পবিষয়ক গবেষক হুমায়ুন আখতার, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি এখানে যে শক্তি সঞ্চিত ছিল সেটা ৮০০ বা ১০০০ বছর আগে ছেড়ে দিয়েছে। এখন নতুন করে শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। তাই আরেকটা বড় মাপের ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে।

বাংলাদেশে বড় ভূমিকম্পের ইতিহাস
সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় ১৫৪৮, ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৭৬২, ১৭৬৫, ১৮১২, ১৮৬৫ ও ১৮৬৯ সালে ভূমিকম্প হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। তবে এসবের মাত্রা কত ছিল তা জানা যায়নি। এছাড়া ১৮২২ ও ১৮১৮ সালে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে ৭ দশমিক ৫ ও ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। অবশ্য এর ক্ষয়ক্ষতির তেমন বর্ণনা পাওয়া যায়নি।

গবেষকদের মতে— গত ১২০-২৫ বছরে মাঝারি ও বড় মাত্রার প্রায় শতাধিক ভূকম্প অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশে। তবে এসবের মধ্যে ৭ বা তার চেয়ে বড় মাত্রার ভূমিকম্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়। যদিও বাংলাদেশ ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে অবস্থিত। এর নিচে যে পরিমাণ শক্তি জমা হয়ে আছে তা বের হলে দেশে বেশ বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments