Monday, May 20, 2024
HomeScrollingলিবিয়াতে সবচেয়ে বড় মাফিয়া হলো বাংলাদেশি দালালেরা

লিবিয়াতে সবচেয়ে বড় মাফিয়া হলো বাংলাদেশি দালালেরা

বিশেষ প্রতিবেদক।।

দালালের খপ্পরে পড়ে সাড়ে আট লাখ টাকায় ঢাকা থেকে দুবাই, সিরিয়া ও লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে চুক্তিবদ্ধ হন বাংলাদেশি অভিবাসী মাহমুদ (ছদ্মনাম)। এই ভুক্তভোগী অভিবাসীবিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন কিভাবে লিবিয়ার পুলিশ তিনিসহ আরও ২৪ জনকে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।

৩১ বছর বয়সি বাংলাদেশি নাগরিক নাজমুল (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। শুরুতে ভালো চললেও লোকসানের কারণে ২০১৯ সালে দেশে ফিরতে বাধ্য হন তিনি। হতাশাগ্রস্থ মাহমুদ এরপর দালালের খপ্পরে পড়ে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সাড়ে দশ লাখ টাকা খরচ করে এখন লিবিয়ায় কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন।

তার মতে, ‘লিবিয়া এমন একটি দেশ যেখানে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন পিছন থেকে আপনাকে বিক্রি করে ফেলবে।’

কিভাবে সেখানে পৌঁছালেন তিনি, গ্রেফতার হয়ে কেমন ছিলেন দেশটির আটককেন্দ্রে, কিভাবেই বা মুক্ত হলেন, এমন সব অভিজ্ঞতা মাহমুদ তুলে ধরেছেন।

প্রশ্ন: আপনি কেন ইউরোপে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন?

নাজমুল: আমি ২০২১ সাল থেকে দীর্ঘ সাত বছরে ওমানে ছিলাম। সেখানে সফলতার সাথে ব্যবসা করছিলাম। এক পর্যায়ে ব্যবসায় ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়লে আমি ২০১৯ সালে দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে অনেক কিছুই করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছিলাম না। সে কারণেই মূলত আবারও বিদেশ আসার সিদ্ধান্ত নেয়া।

প্রশ্ন: লিবিয়া হয়ে ইতালি আসার জন্য দালালের খোঁজ কিভাবে পেলেন?

নাজমুল: তিনি আমার এলাকারই লোক। আমাকে জানান পুরো প্যাকেজ সাড়ে আট লাখ টাকা লাগবে। এই টাকার মধ্যেই ঢাকা থেকে দুবাই, সিরিয়া হয়ে লিবিয়া পৌঁছানো হবে। পরে সেখান থেকে নৌকায় ইতালি। নিজের এলাকার লোক হওয়ায় এবং নানা সমস্যায় থাকায় তার কথার উপর আস্থা রেখে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

প্রশ্ন: ঢাকা থেকে কিভাবে যাত্রা করলেন? লিবিয়ায় আসতে কতদিন লেগেছে? 

নাজমুল: আমি দালালের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ২ আগস্ট ঢাকা থেকে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরের উদ্দেশে যাত্রা করি। আমার সাথে একই দালালের মাধ্যমে চুক্তি করা আরও দুইজন ছিল। প্রথমে তারা আমাদের সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে প্রবেশ করান। দুবাইয়ে আমরা সাত থেকে আট দিন অবস্থান করি। পরে সেখান থেকে দালাল চক্র ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ অর্থাৎ কোন প্রকার ভিসা ছাড়া আমিসহ প্রায় ৫০ থেকে ৫২ জন বাংলাদেশিকে সিরিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সিরিয়ায় দামেস্ক শহরের উদ্দেশে যাত্রার ব্যবস্থা করেন।

তিনি জানান, দুবাই এয়ারপোর্টে আমাদের পাসপোর্টে কোন প্রকার সিল পর্যন্ত মারা হয়নি। এতে করে বুঝা যায়, এটি একটি অনেক বড় মানবপাচার চক্র, যাদের প্রশাসন এবং বিমানবন্দরে গভীর যোগাযোগ রয়েছে। ১০ আগস্ট বিকালে আমরা সিরিয়ার দামেস্ক শহরে এসে পৌঁছাই। পরে সন্ধ্যায় আরও ১০০ জনেরও বেশি অভিবাসী আমাদের সাথে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য যোগ দেয়। ১১ আগস্ট ভোর রাতে তিনটায় আমরা প্রায় ১৬০ জন বাংলাদেশি লিবিয়ার বেনগাজী বিমানবন্দরে অবতরণ করি। কোন প্রকার ভিসা ছাড়াই আমাদেরকে সিরিয়া থেকে ফ্লাইটে লিবিয়ায় নিয়ে আসা হয়।

প্রশ্ন: লিবিয়ায় আসার পর আপনাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়? সমুদ্র পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি কিভাবে নিলেন?

নাজমুল: বেনগাজিতে আসার পরে ১৬০ জন বাংলাদেশির মধ্যে আমরা মাত্র আট জন এই অঞ্চলে থেকে যাই। বাকিরা সবাই রাজধানী ত্রিপোলিতে চলে যান। উল্লেখ্য, এখানে আমরা আটজন ছিলাম একই দালালের যাত্রী। বাকিরা ভিন্ন ভিন্ন দালালের মাধ্যমে এসেছেন। বেনগাজি বিমানবন্দর থেকে অত্যন্ত ভাঙ্গা রাস্তায় ৩০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটি বাসায় নিয়ে আসা হয়। এসব ঘরকে এখানে অভিবাসীরা ‘গেইম ঘর’ বলে। কারণ এখানে থেকেই পরিবর্তিত সমুদ্র যাত্রা বা গেইমের চেষ্টা করা হয়। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে আসার সময় লিবীয় দালালদের সাথে বাংলাদেশি দালালদের প্রতিনিধিও সাথে ছিলেন। তবে তারা অভিবাসীদের সাথে সৈকতে বা উপকূলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

১১ আগস্ট গেইম ঘরে পৌঁছে সেখানে গিয়ে দেখি আগে থেকেই আরও ৩২ জন বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। আমাদের ৪০ জনকে সেখানে ছয় দিন রাখার পরে ১৭ তারিখ উপকূল থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগরে যাত্রা করার কথা বলা হয়। নৌকার চালক ছিলেন একজন সিরীয় নাগরিক। তিনি ছাড়া আমরা সবাই বাংলাদেশি। ১৭ আগস্ট দুপুর একটায় আমরা উপকূল থেকে যাত্রা করি।

প্রশ্ন: এভাবে উত্তাল সাগরে যাত্রা করতে গিয়ে ভয় করেনি? নৌকায় যাত্রার ঘটনা বর্ণনা করুন।

নাজমুল: আমরা লিবিয়া উপকূল থেকে মোট ৪০ জন বাংলাদেশি একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাত্রা শুরু করেছিলাম। নৌকায় আমাদের জন্য পানি, খেজুর আর কিছু শুকনো খাবার রাখা হয়েছিল। দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিন ভূমধ্যসাগরের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত খারাপ ও উত্তাল। টানা ২৫ ঘণ্টা নৌকা চলার পরে এক পর্যায়ে আমরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বোটে আমরা সাত-আট জন ছাড়া সবাই অত্যন্ত অসুস্থ্য হয়ে পড়লে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা আবারও একই উপকূলে ফিরে আসি।

তিনি বলেন, বোটে উঠার আগে আমাদের খুব পাতলা একটি লাইফ জ্যাকেট দেয়া হয়েছিল। যেটি দিয়ে নৌকা ডুবে গেলে বেশিক্ষণ সাগরে টিকে থাকা সম্ভব না। বলতে গেলে আমাদের মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল। সে কারণে আমরা সেদিন ফিরে এসেছিলাম।

প্রশ্ন: লিবিয়া কোস্টগার্ড ঘনিষ্ঠ টুইটার একাউন্ট মাইগ্রেন্ট রেসকিউ ওয়াচ ২১ আগস্ট তাদের টুইটার একাউন্টে উপকূল থেকে ৩২ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এই দলেই কি আপনারা ছিলেন? আপনারা তো ছিলেন সংখ্যায় ৪০ জন?

নাজমুল: জ্বি, সেই ভিডিওতেই আমরা ছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমরা উপকূল ত্যাগ করে ওই অঞ্চলের একটি এলাকায় হাঁটার সময় কোস্টগার্ডের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমাদের সাথে থাকা আট জন কোস্টগার্ড দেখে পালাতে সক্ষম হয়। বাকি ৩২ জন আটক হয়। আমাদের মূলত ১৭ তারিখ গ্রেফতার করা হয়েছিল।

প্রশ্ন: কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়ার পর আপনাদের সবার কী পরিণতি হলো?

নাজমুল: লিবিয়া কোস্টগার্ড আমাদের আটকের পর একটি খোলা জায়গায় তপ্ত রোদে টানা চারদিন ফেলে রাখে। আমাদের কোন প্রকার খাবার দেয়া হয় নি। শুধু পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। এই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমাদেরকে দালাল চাইলে কোস্টগার্ডের হাত থেকে নিয়ে আসতে পারত। আমাদের সাথে থাকা ৩২ জনের মধ্যে আট জন কোস্টগার্ড থেকে মুক্তি পেয়ে চলে যায়।

প্রশ্ন: পাঁচদিন পর কোস্টগার্ড কি আপনাদের ছেড়ে দেয়? 

নাজমুল: এটি হলে তো খুব ভাল হতো। কিন্তু চার দিন পর তারা আমাদের বাকি ২৪ জনকে লিবিয়ার বেনগাজির কাছে গামবুদা নামের একটি আটককেন্দ্র বা জেলে পাঠিয়ে দেয়। লিবিয়ার জেলের পরিবেশ অত্যন্ত ভয়ংকর ও অমানবিক। আমরা একটি কক্ষে একসাথে ৩২ জন ছিলাম। একজনের পরিমাণ খাবার দিত প্রতি বেলায় সেটি পাঁচজনকে ভাগ করে খেতে হতো। সকালে বাসি খাবার দিত এগুলো খাওয়া যেত না। সকালে নষ্ট ডাল দিয়ে গবজা নামের এক প্রকার বনরুটি দিত। আমি এগুলো খেতে পারিনি একদিনও।
জেলে মোট পাঁচদিন ছিলাম। এটি জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি।

প্রশ্ন: সেখান থেকে কিভাবে মুক্তি পেলেন? আপনার সাথে কি ফোন ছিল?

নাজমুল: সাধারণত এরা কোথাও অভিবাসীদের ফোন রাখতে দেয় না। কিন্তু আমার কাছে দুইটি ফোন থাকায় একটি নিতে পারে নি। সেটি দিয়ে দালালের সাথে যোগাযোগ এবং বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। চারদিন জেলে থাকার পর লিবিয়া পুলিশ জনপ্রতি ৫০০ দিনারের (১০ হাজার টাকা) বিনিময়ে আমাদেরকে আবারও বাংলাদেশি দালালের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে দালাল আমাদের সবার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে। তারা জানায় পুলিশের সাথে গোপন চুক্তি করে অনেক কষ্টে তাদের ছাড়ানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি বাধ্য হয়ে দালালের বাংলাদেশ প্রতিনিধির একটি বাংলাদেশি ব্যাংক একাউন্টে আমার পরিবারের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা পরিশোধ করি। যদিও আমার সাথে চুক্তি ছিল ইতালি পৌঁছানো পর্যন্ত সাড়ে আট লাখ টাকা কিন্তু আরও অতিরিক্ত দুই লাখ টাকাসহ আমি সাড়ে দশ লাখ টাকা এরমধ্যে দিয়ে দিয়েছি। এভাবে নানা অজুহাতে জিম্মি করে তারা টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে নেয়। এসব পরিস্থিতিতে করার তেমন কিছুই থাকে না।

প্রশ্ন: এখন আপনার পরিকল্পনা কী? এভাবে যারা বাংলাদেশ থেকে আসতে চান তাদের উদ্দেশে আপনি কী পরামর্শ দিবেন?

নাজমুল: লিবিয়াতে সবচেয়ে বড় মাফিয়া হলো বাংলাদেশি দালালেরা। লিবিয়া এমন একটি দেশ যেখানে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন পিছন থেকে আপনাকে বিক্রি করে ফেলবে। এমনকি আমাদের যে বাসায় রাখা হয় সেই বাসার সামনেও যেতে দেয় না। লিবীয় আর বাংলাদেশি মাফিয়ারা মানুষের কাতারে পড়ে না। জেলে কিছু লোকের সাথে দেখা হয়েছে তাদের কান্না দেখে আমার নিজের চোখে পানি চলে আসছিল। একজন মিশরীয় নাগরিককে মাত্র তিন বছর বয়সি বাচ্চাকে নিয়ে জেলে দেখেছি।  অনেক লোক বাংলাদেশ থেকে আসার পর ২৫ লাখ টাকা খরচ করেও এখনও লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে পারেনি। এখানে পুলিশে কিছুদিন আটক রেখে পুনরায় মাফিয়া বা মানবপাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।

প্রশ্ন: এই যে ঢাকা থেকে দুবাই, তারপর সেখান থেকে সিরিয়া, লিবিয়া কোন প্রকার ভিসা ছাড়া এটা তো একটা আন্তজার্তিক চক্র ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব না। আপনি কী মনে করেন?

দালালের খপ্পরে পড়ে সাড়ে আট লাখ টাকায় ঢাকা থেকে দুবাই, সিরিয়া ও লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে চুক্তিবদ্ধ হন বাংলাদেশি অভিবাসী নাজমুল (ছদ্মনাম)। এই ভুক্তভোগী অভিবাসীবিষয়ক সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টসকে জানিয়েছেন কিভাবে লিবিয়ার পুলিশ তিনিসহ আরও ২৪ জনকে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।

৩১ বছর বয়সি বাংলাদেশি নাগরিক নাজমুল (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। শুরুতে ভালো চললেও লোকসানের কারণে ২০১৯ সালে দেশে ফিরতে বাধ্য হন তিনি। হতাশাগ্রস্থ মাহমুদ এরপর দালালের খপ্পরে পড়ে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সাড়ে দশ লাখ টাকা খরচ করে এখন লিবিয়ায় কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন।

তার মতে, ‘লিবিয়া এমন একটি দেশ যেখানে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন পিছন থেকে আপনাকে বিক্রি করে ফেলবে।’

কিভাবে সেখানে পৌঁছালেন তিনি, গ্রেফতার হয়ে কেমন ছিলেন দেশটির আটককেন্দ্রে, কিভাবেই বা মুক্ত হলেন, এমন সব অভিজ্ঞতা মাহমুদ তুলে ধরেছেন।

প্রশ্ন: আপনি কেন ইউরোপে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন?

নাজমুল: আমি ২০২১ সাল থেকে দীর্ঘ সাত বছরে ওমানে ছিলাম। সেখানে সফলতার সাথে ব্যবসা করছিলাম। এক পর্যায়ে ব্যবসায় ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়লে আমি ২০১৯ সালে দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে অনেক কিছুই করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছিলাম না। সে কারণেই মূলত আবারও বিদেশ আসার সিদ্ধান্ত নেয়া।

প্রশ্ন: লিবিয়া হয়ে ইতালি আসার জন্য দালালের খোঁজ কিভাবে পেলেন?

নাজমুল: তিনি আমার এলাকারই লোক। আমাকে জানান পুরো প্যাকেজ সাড়ে আট লাখ টাকা লাগবে। এই টাকার মধ্যেই ঢাকা থেকে দুবাই, সিরিয়া হয়ে লিবিয়া পৌঁছানো হবে। পরে সেখান থেকে নৌকায় ইতালি। নিজের এলাকার লোক হওয়ায় এবং নানা সমস্যায় থাকায় তার কথার উপর আস্থা রেখে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

প্রশ্ন: ঢাকা থেকে কিভাবে যাত্রা করলেন? লিবিয়ায় আসতে কতদিন লেগেছে? 

নাজমুল: আমি দালালের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ২ আগস্ট ঢাকা থেকে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরের উদ্দেশে যাত্রা করি। আমার সাথে একই দালালের মাধ্যমে চুক্তি করা আরও দুইজন ছিল। প্রথমে তারা আমাদের সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে প্রবেশ করান। দুবাইয়ে আমরা সাত থেকে আট দিন অবস্থান করি। পরে সেখান থেকে দালাল চক্র ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ অর্থাৎ কোন প্রকার ভিসা ছাড়া আমিসহ প্রায় ৫০ থেকে ৫২ জন বাংলাদেশিকে সিরিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সিরিয়ায় দামেস্ক শহরের উদ্দেশে যাত্রার ব্যবস্থা করেন।

তিনি জানান, দুবাই এয়ারপোর্টে আমাদের পাসপোর্টে কোন প্রকার সিল পর্যন্ত মারা হয়নি। এতে করে বুঝা যায়, এটি একটি অনেক বড় মানবপাচার চক্র, যাদের প্রশাসন এবং বিমানবন্দরে গভীর যোগাযোগ রয়েছে। ১০ আগস্ট বিকালে আমরা সিরিয়ার দামেস্ক শহরে এসে পৌঁছাই। পরে সন্ধ্যায় আরও ১০০ জনেরও বেশি অভিবাসী আমাদের সাথে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য যোগ দেয়। ১১ আগস্ট ভোর রাতে তিনটায় আমরা প্রায় ১৬০ জন বাংলাদেশি লিবিয়ার বেনগাজী বিমানবন্দরে অবতরণ করি। কোন প্রকার ভিসা ছাড়াই আমাদেরকে সিরিয়া থেকে ফ্লাইটে লিবিয়ায় নিয়ে আসা হয়।

প্রশ্ন: লিবিয়ায় আসার পর আপনাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়? সমুদ্র পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি কিভাবে নিলেন?

নাজমুল: বেনগাজিতে আসার পরে ১৬০ জন বাংলাদেশির মধ্যে আমরা মাত্র আট জন এই অঞ্চলে থেকে যাই। বাকিরা সবাই রাজধানী ত্রিপোলিতে চলে যান। উল্লেখ্য, এখানে আমরা আটজন ছিলাম একই দালালের যাত্রী। বাকিরা ভিন্ন ভিন্ন দালালের মাধ্যমে এসেছেন। বেনগাজি বিমানবন্দর থেকে অত্যন্ত ভাঙ্গা রাস্তায় ৩০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটি বাসায় নিয়ে আসা হয়। এসব ঘরকে এখানে অভিবাসীরা ‘গেইম ঘর’ বলে। কারণ এখানে থেকেই পরিবর্তিত সমুদ্র যাত্রা বা গেইমের চেষ্টা করা হয়। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে আসার সময় লিবীয় দালালদের সাথে বাংলাদেশি দালালদের প্রতিনিধিও সাথে ছিলেন। তবে তারা অভিবাসীদের সাথে সৈকতে বা উপকূলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

১১ আগস্ট গেইম ঘরে পৌঁছে সেখানে গিয়ে দেখি আগে থেকেই আরও ৩২ জন বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। আমাদের ৪০ জনকে সেখানে ছয় দিন রাখার পরে ১৭ তারিখ উপকূল থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগরে যাত্রা করার কথা বলা হয়। নৌকার চালক ছিলেন একজন সিরীয় নাগরিক। তিনি ছাড়া আমরা সবাই বাংলাদেশি। ১৭ আগস্ট দুপুর একটায় আমরা উপকূল থেকে যাত্রা করি।

প্রশ্ন: এভাবে উত্তাল সাগরে যাত্রা করতে গিয়ে ভয় করেনি? নৌকায় যাত্রার ঘটনা বর্ণনা করুন।

নাজমুল: আমরা লিবিয়া উপকূল থেকে মোট ৪০ জন বাংলাদেশি একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাত্রা শুরু করেছিলাম। নৌকায় আমাদের জন্য পানি, খেজুর আর কিছু শুকনো খাবার রাখা হয়েছিল। দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিন ভূমধ্যসাগরের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত খারাপ ও উত্তাল। টানা ২৫ ঘণ্টা নৌকা চলার পরে এক পর্যায়ে আমরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বোটে আমরা সাত-আট জন ছাড়া সবাই অত্যন্ত অসুস্থ্য হয়ে পড়লে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা আবারও একই উপকূলে ফিরে আসি।

তিনি বলেন, বোটে উঠার আগে আমাদের খুব পাতলা একটি লাইফ জ্যাকেট দেয়া হয়েছিল। যেটি দিয়ে নৌকা ডুবে গেলে বেশিক্ষণ সাগরে টিকে থাকা সম্ভব না। বলতে গেলে আমাদের মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল। সে কারণে আমরা সেদিন ফিরে এসেছিলাম।

প্রশ্ন: লিবিয়া কোস্টগার্ড ঘনিষ্ঠ টুইটার একাউন্ট মাইগ্রেন্ট রেসকিউ ওয়াচ ২১ আগস্ট তাদের টুইটার একাউন্টে উপকূল থেকে ৩২ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এই দলেই কি আপনারা ছিলেন? আপনারা তো ছিলেন সংখ্যায় ৪০ জন?

নাজমুল: জ্বি, সেই ভিডিওতেই আমরা ছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমরা উপকূল ত্যাগ করে ওই অঞ্চলের একটি এলাকায় হাঁটার সময় কোস্টগার্ডের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমাদের সাথে থাকা আট জন কোস্টগার্ড দেখে পালাতে সক্ষম হয়। বাকি ৩২ জন আটক হয়। আমাদের মূলত ১৭ তারিখ গ্রেফতার করা হয়েছিল।

প্রশ্ন: কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়ার পর আপনাদের সবার কী পরিণতি হলো?

নাজমুল: লিবিয়া কোস্টগার্ড আমাদের আটকের পর একটি খোলা জায়গায় তপ্ত রোদে টানা চারদিন ফেলে রাখে। আমাদের কোন প্রকার খাবার দেয়া হয় নি। শুধু পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। এই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমাদেরকে দালাল চাইলে কোস্টগার্ডের হাত থেকে নিয়ে আসতে পারত। আমাদের সাথে থাকা ৩২ জনের মধ্যে আট জন কোস্টগার্ড থেকে মুক্তি পেয়ে চলে যায়।

প্রশ্ন: পাঁচদিন পর কোস্টগার্ড কি আপনাদের ছেড়ে দেয়? 

নাজমুল: এটি হলে তো খুব ভাল হতো। কিন্তু চার দিন পর তারা আমাদের বাকি ২৪ জনকে লিবিয়ার বেনগাজির কাছে গামবুদা নামের একটি আটককেন্দ্র বা জেলে পাঠিয়ে দেয়। লিবিয়ার জেলের পরিবেশ অত্যন্ত ভয়ংকর ও অমানবিক। আমরা একটি কক্ষে একসাথে ৩২ জন ছিলাম। একজনের পরিমাণ খাবার দিত প্রতি বেলায় সেটি পাঁচজনকে ভাগ করে খেতে হতো। সকালে বাসি খাবার দিত এগুলো খাওয়া যেত না। সকালে নষ্ট ডাল দিয়ে গবজা নামের এক প্রকার বনরুটি দিত। আমি এগুলো খেতে পারিনি একদিনও।
জেলে মোট পাঁচদিন ছিলাম। এটি জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি।

প্রশ্ন: সেখান থেকে কিভাবে মুক্তি পেলেন? আপনার সাথে কি ফোন ছিল?

নাজমুল: সাধারণত এরা কোথাও অভিবাসীদের ফোন রাখতে দেয় না। কিন্তু আমার কাছে দুইটি ফোন থাকায় একটি নিতে পারে নি। সেটি দিয়ে দালালের সাথে যোগাযোগ এবং বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। চারদিন জেলে থাকার পর লিবিয়া পুলিশ জনপ্রতি ৫০০ দিনারের (১০ হাজার টাকা) বিনিময়ে আমাদেরকে আবারও বাংলাদেশি দালালের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে দালাল আমাদের সবার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে। তারা জানায় পুলিশের সাথে গোপন চুক্তি করে অনেক কষ্টে তাদের ছাড়ানো হয়ে

তিনি বলেন, আমি বাধ্য হয়ে দালালের বাংলাদেশ প্রতিনিধির একটি বাংলাদেশি ব্যাংক একাউন্টে আমার পরিবারের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা পরিশোধ করি। যদিও আমার সাথে চুক্তি ছিল ইতালি পৌঁছানো পর্যন্ত সাড়ে আট লাখ টাকা কিন্তু আরও অতিরিক্ত দুই লাখ টাকাসহ আমি সাড়ে দশ লাখ টাকা এরমধ্যে দিয়ে দিয়েছি। এভাবে নানা অজুহাতে জিম্মি করে তারা টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে নেয়। এসব পরিস্থিতিতে করার তেমন কিছুই থাকে না।

প্রশ্ন: এখন আপনার পরিকল্পনা কী? এভাবে যারা বাংলাদেশ থেকে আসতে চান তাদের উদ্দেশে আপনি কী পরামর্শ দিবেন?

নাজমুল: লিবিয়াতে সবচেয়ে বড় মাফিয়া হলো বাংলাদেশি দালালেরা। লিবিয়া এমন একটি দেশ যেখানে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন পিছন থেকে আপনাকে বিক্রি করে ফেলবে। এমনকি আমাদের যে বাসায় রাখা হয় সেই বাসার সামনেও যেতে দেয় না। লিবীয় আর বাংলাদেশি মাফিয়ারা মানুষের কাতারে পড়ে না। জেলে কিছু লোকের সাথে দেখা হয়েছে তাদের কান্না দেখে আমার নিজের চোখে পানি চলে আসছিল। একজন মিশরীয় নাগরিককে মাত্র তিন বছর বয়সি বাচ্চাকে নিয়ে জেলে দেখেছি।  অনেক লোক বাংলাদেশ থেকে আসার পর ২৫ লাখ টাকা খরচ করেও এখনও লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে পারেনি। এখানে পুলিশে কিছুদিন আটক রেখে পুনরায় মাফিয়া বা মানবপাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।

প্রশ্ন: এই যে ঢাকা থেকে দুবাই, তারপর সেখান থেকে সিরিয়া, লিবিয়া কোন প্রকার ভিসা ছাড়া এটা তো একটা আন্তজার্তিক চক্র ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব না। আপনি কী মনে করেন?

নাজমুল: এটি একটি বিশাল চক্র। তারা গ্রুপে গ্রুপে ঢাকা থেকে দুবাই আনে সবাইকে। এসব দরিদ্র লোকেদের সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন অযথা ভ্রমণ ভিসা ইস্যু করবে কিংবা বাংলাদশ কর্তৃপক্ষই ইমিগ্রেশন পার হতে দিবে কেন? সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় দুবাই এয়ারপোর্টে আমাদের কারও পাসপোর্টে সিল মারা হয়নি। একসাথে এতগুলো বাংলাদেশি সেখান থেকে লিবিয়ায় কেন ফ্লাইট করবে এটি তো কর্তৃপক্ষের জানার কথা। বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিরিয়া এবং লিবিয়া সবগুলো দেশের উচ্চ পর্যায়ে মানবপাচার চক্র বা মাফিয়াদের সংযোগ ছাড়া নিয়মিত হাজারো লোককে এভাবে পাচার করা সম্ভব না।

তিনি বলেন, এখন আমার আর পেছনে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। বারবার চেষ্টা করতে হবে গেইম মারার। কারণ সব টাকা খরচ করে ফেলেছি। যারা বাংলাদেশ থেকে এভাবে আসতে চান তারা আমার অভিজ্ঞতা শুনেই সিদ্ধান্ত নিবেন এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিবেন কি না। এটি কঠিন এক পথ! ৯০ ভাগ ঘটনায় মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।ল

দালালের খপ্পরে পড়ে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় ঢাকা থেকে দুবাই, সিরিয়া ও লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে চুক্তিবদ্ধ হন বাংলাদেশি অভিবাসী নাজমুল (ছদ্মনাম)। এই ভুক্তভোগী জানিয়েছেন কিভাবে লিবিয়ার পুলিশ তিনিসহ আরও ২৪ জনকে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।

৩১ বছর বয়সি বাংলাদেশি নাগরিক মাহমুদ (ছদ্মনাম) দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছিলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে। শুরুতে ভালো চললেও লোকসানের কারণে ২০১৯ সালে দেশে ফিরতে বাধ্য হন তিনি। হতাশাগ্রস্থ মাহমুদ এরপর দালালের খপ্পরে পড়ে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। সাড়ে দশ লাখ টাকা খরচ করে এখন লিবিয়ায় কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন।

তার মতে, ‘লিবিয়া এমন একটি দেশ যেখানে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন পিছন থেকে আপনাকে বিক্রি করে ফেলবে।’

কিভাবে সেখানে পৌঁছালেন তিনি, গ্রেফতার হয়ে কেমন ছিলেন দেশটির আটককেন্দ্রে, কিভাবেই বা মুক্ত হলেন, এমন সব অভিজ্ঞতা মাহমুদ তুলে ধরেছেন।

প্রশ্ন: আপনি কেন ইউরোপে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন?

নাজমুল: আমি ২০২১ সাল থেকে দীর্ঘ সাত বছরে ওমানে ছিলাম। সেখানে সফলতার সাথে ব্যবসা করছিলাম। এক পর্যায়ে ব্যবসায় ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়লে আমি ২০১৯ সালে দেশে ফিরে আসি। দেশে ফিরে অনেক কিছুই করার চেষ্টা করি। কিন্তু কিছুতেই সফল হতে পারছিলাম না। সে কারণেই মূলত আবারও বিদেশ আসার সিদ্ধান্ত নেয়া।

প্রশ্ন: লিবিয়া হয়ে ইতালি আসার জন্য দালালের খোঁজ কিভাবে পেলেন?

নাজমুল: তিনি আমার এলাকারই লোক। আমাকে জানান পুরো প্যাকেজ সাড়ে আট লাখ টাকা লাগবে। এই টাকার মধ্যেই ঢাকা থেকে দুবাই, সিরিয়া হয়ে লিবিয়া পৌঁছানো হবে। পরে সেখান থেকে নৌকায় ইতালি। নিজের এলাকার লোক হওয়ায় এবং নানা সমস্যায় থাকায় তার কথার উপর আস্থা রেখে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

প্রশ্ন: ঢাকা থেকে কিভাবে যাত্রা করলেন? লিবিয়ায় আসতে কতদিন লেগেছে? 

নাজমুল: আমি দালালের সাথে চুক্তি অনুযায়ী ২ আগস্ট ঢাকা থেকে এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরের উদ্দেশে যাত্রা করি। আমার সাথে একই দালালের মাধ্যমে চুক্তি করা আরও দুইজন ছিল। প্রথমে তারা আমাদের সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে প্রবেশ করান। দুবাইয়ে আমরা সাত থেকে আট দিন অবস্থান করি। পরে সেখান থেকে দালাল চক্র ‘বডি কন্ট্রাক্ট’ অর্থাৎ কোন প্রকার ভিসা ছাড়া আমিসহ প্রায় ৫০ থেকে ৫২ জন বাংলাদেশিকে সিরিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সিরিয়ায় দামেস্ক শহরের উদ্দেশে যাত্রার ব্যবস্থা করেন।

তিনি জানান, দুবাই এয়ারপোর্টে আমাদের পাসপোর্টে কোন প্রকার সিল পর্যন্ত মারা হয়নি। এতে করে বুঝা যায়, এটি একটি অনেক বড় মানবপাচার চক্র, যাদের প্রশাসন এবং বিমানবন্দরে গভীর যোগাযোগ রয়েছে। ১০ আগস্ট বিকালে আমরা সিরিয়ার দামেস্ক শহরে এসে পৌঁছাই। পরে সন্ধ্যায় আরও ১০০ জনেরও বেশি অভিবাসী আমাদের সাথে পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য যোগ দেয়। ১১ আগস্ট ভোর রাতে তিনটায় আমরা প্রায় ১৬০ জন বাংলাদেশি লিবিয়ার বেনগাজী বিমানবন্দরে অবতরণ করি। কোন প্রকার ভিসা ছাড়াই আমাদেরকে সিরিয়া থেকে ফ্লাইটে লিবিয়ায় নিয়ে আসা হয়।

প্রশ্ন: লিবিয়ায় আসার পর আপনাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়? সমুদ্র পাড়ি দেয়ার প্রস্তুতি কিভাবে নিলেন?

নাজমুল: বেনগাজিতে আসার পরে ১৬০ জন বাংলাদেশির মধ্যে আমরা মাত্র আট জন এই অঞ্চলে থেকে যাই। বাকিরা সবাই রাজধানী ত্রিপোলিতে চলে যান। উল্লেখ্য, এখানে আমরা আটজন ছিলাম একই দালালের যাত্রী। বাকিরা ভিন্ন ভিন্ন দালালের মাধ্যমে এসেছেন। বেনগাজি বিমানবন্দর থেকে অত্যন্ত ভাঙ্গা রাস্তায় ৩০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে একটি বাসায় নিয়ে আসা হয়। এসব ঘরকে এখানে অভিবাসীরা ‘গেইম ঘর’ বলে। কারণ এখানে থেকেই পরিবর্তিত সমুদ্র যাত্রা বা গেইমের চেষ্টা করা হয়। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে আসার সময় লিবীয় দালালদের সাথে বাংলাদেশি দালালদের প্রতিনিধিও সাথে ছিলেন। তবে তারা অভিবাসীদের সাথে সৈকতে বা উপকূলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন।

১১ আগস্ট গেইম ঘরে পৌঁছে সেখানে গিয়ে দেখি আগে থেকেই আরও ৩২ জন বাংলাদেশি অবস্থান করছেন। আমাদের ৪০ জনকে সেখানে ছয় দিন রাখার পরে ১৭ তারিখ উপকূল থেকে নৌকায় ভূমধ্যসাগরে যাত্রা করার কথা বলা হয়। নৌকার চালক ছিলেন একজন সিরীয় নাগরিক। তিনি ছাড়া আমরা সবাই বাংলাদেশি। ১৭ আগস্ট দুপুর একটায় আমরা উপকূল থেকে যাত্রা করি।

প্রশ্ন: এভাবে উত্তাল সাগরে যাত্রা করতে গিয়ে ভয় করেনি? নৌকায় যাত্রার ঘটনা বর্ণনা করুন।

নাজমুল: আমরা লিবিয়া উপকূল থেকে মোট ৪০ জন বাংলাদেশি একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাত্রা শুরু করেছিলাম। নৌকায় আমাদের জন্য পানি, খেজুর আর কিছু শুকনো খাবার রাখা হয়েছিল। দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেদিন ভূমধ্যসাগরের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত খারাপ ও উত্তাল। টানা ২৫ ঘণ্টা নৌকা চলার পরে এক পর্যায়ে আমরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বোটে আমরা সাত-আট জন ছাড়া সবাই অত্যন্ত অসুস্থ্য হয়ে পড়লে সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আমরা আবারও একই উপকূলে ফিরে আসি।

তিনি বলেন, বোটে উঠার আগে আমাদের খুব পাতলা একটি লাইফ জ্যাকেট দেয়া হয়েছিল। যেটি দিয়ে নৌকা ডুবে গেলে বেশিক্ষণ সাগরে টিকে থাকা সম্ভব না। বলতে গেলে আমাদের মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল। সে কারণে আমরা সেদিন ফিরে এসেছিলাম।

প্রশ্ন: লিবিয়া কোস্টগার্ড ঘনিষ্ঠ টুইটার একাউন্ট মাইগ্রেন্ট রেসকিউ ওয়াচ ২১ আগস্ট তাদের টুইটার একাউন্টে উপকূল থেকে ৩২ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনার একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এই দলেই কি আপনারা ছিলেন? আপনারা তো ছিলেন সংখ্যায় ৪০ জন?

নাজমুল: জ্বি, সেই ভিডিওতেই আমরা ছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমরা উপকূল ত্যাগ করে ওই অঞ্চলের একটি এলাকায় হাঁটার সময় কোস্টগার্ডের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলাম। আমাদের সাথে থাকা আট জন কোস্টগার্ড দেখে পালাতে সক্ষম হয়। বাকি ৩২ জন আটক হয়। আমাদের মূলত ১৭ তারিখ গ্রেফতার করা হয়েছিল।

প্রশ্ন: কোস্টগার্ডের হাতে আটক হওয়ার পর আপনাদের সবার কী পরিণতি হলো?

নাজমুল: লিবিয়া কোস্টগার্ড আমাদের আটকের পর একটি খোলা জায়গায় তপ্ত রোদে টানা চারদিন ফেলে রাখে। আমাদের কোন প্রকার খাবার দেয়া হয় নি। শুধু পানি খেয়ে বেঁচে ছিলাম। এই অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমাদেরকে দালাল চাইলে কোস্টগার্ডের হাত থেকে নিয়ে আসতে পারত। আমাদের সাথে থাকা ৩২ জনের মধ্যে আট জন কোস্টগার্ড থেকে মুক্তি পেয়ে চলে যায়।

প্রশ্ন: পাঁচদিন পর কোস্টগার্ড কি আপনাদের ছেড়ে দেয়? 

নাজমুল: এটি হলে তো খুব ভাল হতো। কিন্তু চার দিন পর তারা আমাদের বাকি ২৪ জনকে লিবিয়ার বেনগাজির কাছে গামবুদা নামের একটি আটককেন্দ্র বা জেলে পাঠিয়ে দেয়। লিবিয়ার জেলের পরিবেশ অত্যন্ত ভয়ংকর ও অমানবিক। আমরা একটি কক্ষে একসাথে ৩২ জন ছিলাম। একজনের পরিমাণ খাবার দিত প্রতি বেলায় সেটি পাঁচজনকে ভাগ করে খেতে হতো। সকালে বাসি খাবার দিত এগুলো খাওয়া যেত না। সকালে নষ্ট ডাল দিয়ে গবজা নামের এক প্রকার বনরুটি দিত। আমি এগুলো খেতে পারিনি একদিনও।
জেলে মোট পাঁচদিন ছিলাম। এটি জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি।

প্রশ্ন: সেখান থেকে কিভাবে মুক্তি পেলেন? আপনার সাথে কি ফোন ছিল?

নাজমুল: সাধারণত এরা কোথাও অভিবাসীদের ফোন রাখতে দেয় না। কিন্তু আমার কাছে দুইটি ফোন থাকায় একটি নিতে পারে নি। সেটি দিয়ে দালালের সাথে যোগাযোগ এবং বেশ কিছু ছবি তুলেছিলাম। চারদিন জেলে থাকার পর লিবিয়া পুলিশ জনপ্রতি ৫০০ দিনারের (১০ হাজার টাকা) বিনিময়ে আমাদেরকে আবারও বাংলাদেশি দালালের হাতে তুলে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে দালাল আমাদের সবার কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে। তারা জানায় পুলিশের সাথে গোপন চুক্তি করে অনেক কষ্টে তাদের ছাড়ানো হয়েছে।

তিনি বলেন, আমি বাধ্য হয়ে দালালের বাংলাদেশ প্রতিনিধির একটি বাংলাদেশি ব্যাংক একাউন্টে আমার পরিবারের মাধ্যমে দুই লাখ টাকা পরিশোধ করি। যদিও আমার সাথে চুক্তি ছিল ইতালি পৌঁছানো পর্যন্ত সাড়ে আট লাখ টাকা কিন্তু আরও অতিরিক্ত দুই লাখ টাকাসহ আমি সাড়ে দশ লাখ টাকা এরমধ্যে দিয়ে দিয়েছি। এভাবে নানা অজুহাতে জিম্মি করে তারা টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে নেয়। এসব পরিস্থিতিতে করার তেমন কিছুই থাকে না।

প্রশ্ন: এখন আপনার পরিকল্পনা কী? এভাবে যারা বাংলাদেশ থেকে আসতে চান তাদের উদ্দেশে আপনি কী পরামর্শ দিবেন?

নাজমুল: লিবিয়াতে সবচেয়ে বড় মাফিয়া হলো বাংলাদেশি দালালেরা। লিবিয়া এমন একটি দেশ যেখানে আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটবেন পিছন থেকে আপনাকে বিক্রি করে ফেলবে। এমনকি আমাদের যে বাসায় রাখা হয় সেই বাসার সামনেও যেতে দেয় না। লিবীয় আর বাংলাদেশি মাফিয়ারা মানুষের কাতারে পড়ে না। জেলে কিছু লোকের সাথে দেখা হয়েছে তাদের কান্না দেখে আমার নিজের চোখে পানি চলে আসছিল। একজন মিশরীয় নাগরিককে মাত্র তিন বছর বয়সি বাচ্চাকে নিয়ে জেলে দেখেছি।  অনেক লোক বাংলাদেশ থেকে আসার পর ২৫ লাখ টাকা খরচ করেও এখনও লিবিয়া থেকে ইতালি যেতে পারেনি। এখানে পুলিশে কিছুদিন আটক রেখে পুনরায় মাফিয়া বা মানবপাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেয়।

প্রশ্ন: এই যে ঢাকা থেকে দুবাই, তারপর সেখান থেকে সিরিয়া, লিবিয়া কোন প্রকার ভিসা ছাড়া এটা তো একটা আন্তজার্তিক চক্র ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব না। আপনি কী মনে করেন?

নাজমুল: এটি একটি বিশাল চক্র। তারা গ্রুপে গ্রুপে ঢাকা থেকে দুবাই আনে সবাইকে। এসব দরিদ্র লোকেদের সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন অযথা ভ্রমণ ভিসা ইস্যু করবে কিংবা বাংলাদশ কর্তৃপক্ষই ইমিগ্রেশন পার হতে দিবে কেন? সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় দুবাই এয়ারপোর্টে আমাদের কারও পাসপোর্টে সিল মারা হয়নি। একসাথে এতগুলো বাংলাদেশি সেখান থেকে লিবিয়ায় কেন ফ্লাইট করবে এটি তো কর্তৃপক্ষের জানার কথা। বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিরিয়া এবং লিবিয়া সবগুলো দেশের উচ্চ পর্যায়ে মানবপাচার চক্র বা মাফিয়াদের সংযোগ ছাড়া নিয়মিত হাজারো লোককে এভাবে পাচার করা সম্ভব না।

তিনি বলেন, এখন আমার আর পেছনে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। বারবার চেষ্টা করতে হবে গেইম মারার। কারণ সব টাকা খরচ করে ফেলেছি। যারা বাংলাদেশ থেকে এভাবে আসতে চান তারা আমার অভিজ্ঞতা শুনেই সিদ্ধান্ত নিবেন এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিবেন কি না। এটি কঠিন এক পথ! ৯০ ভাগ ঘটনায় মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।

নাজমুল : এটি একটি বিশাল চক্র। তারা গ্রুপে গ্রুপে ঢাকা থেকে দুবাই আনে সবাইকে। এসব দরিদ্র লোকেদের সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন অযথা ভ্রমণ ভিসা ইস্যু করবে কিংবা বাংলাদশ কর্তৃপক্ষই ইমিগ্রেশন পার হতে দিবে কেন? সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় দুবাই এয়ারপোর্টে আমাদের কারও পাসপোর্টে সিল মারা হয়নি। একসাথে এতগুলো বাংলাদেশি সেখান থেকে লিবিয়ায় কেন ফ্লাইট করবে এটি তো কর্তৃপক্ষের জানার কথা। বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিরিয়া এবং লিবিয়া সবগুলো দেশের উচ্চ পর্যায়ে মানবপাচার চক্র বা মাফিয়াদের সংযোগ ছাড়া নিয়মিত হাজারো লোককে এভাবে পাচার করা সম্ভব না।

তিনি বলেন, এখন আমার আর পেছনে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। বারবার চেষ্টা করতে হবে গেইম মারার। কারণ সব টাকা খরচ করে ফেলেছি। যারা বাংলাদেশ থেকে এভাবে আসতে চান তারা আমার অভিজ্ঞতা শুনেই সিদ্ধান্ত নিবেন এই পথে জীবনের ঝুঁকি নিবেন কি না। এটি কঠিন এক পথ! ৯০ ভাগ ঘটনায় মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে।

 

বিশেষ প্রতিবেন করতে সহযোগীতা করেছেন-লিবিয়িা হয়ে ইতালী পৌছানো প্রবাসী(বর্তমান)

LN24BD/ মিডিয়া সুত্র.

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments