Sunday, July 6, 2025
HomeScrollingবিশ্বজুড়ে তীব্র খরা, চরম আঘাত আসতে পারে অর্থনীতির ওপর

বিশ্বজুড়ে তীব্র খরা, চরম আঘাত আসতে পারে অর্থনীতির ওপর

অনলাইন ডেস্ক।

তীব্র তাপপ্রবাহ এবং খরার কারণে বিশ্বর সবচেয়ে বড় তিন অর্থনীতি- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনের প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ইতিমধ্যেই মন্থর হয়ে এসেছিল এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠছিল জনগণের। তার মধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এই নজিরবিহীন খরার আঘাত পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

চীনের সিচুয়ান প্রদেশে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য সমস্ত কারখানা ছয় দিনের জন্য বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কয়লা এবং রাসায়নিক বহনকারী জাহাজগুলো জার্মানির রাইন নদীর ওপর দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে বসবাসকারী মানুষদের তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে বলা হয়েছে।

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চের পরিচালক বেন মে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এই খরার প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে বিশ্ব।

তাপপ্রবাহ এবং বৃষ্টির অভাব কতদিন স্থায়ী হয় তার ওপর নির্ভর করবে ক্ষতির পরিমাণ। কিন্তু জার্মানির মতো দেশে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, সেখানে সামান্যই স্বস্তি দেখা যাচ্ছে এবং কোম্পানিগুলো সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া এবং অর্থনৈতিক মন্দা

শুধু জার্মানির রাইন নদী নয়। সারা বিশ্বে যে নদীগুলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে, যেমন- ইয়াংজি, দানিউব এবং কলোরাডোর মতো নদীগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে পণ্য চলাচলে বাধা সৃষ্টি হওয়া থেকে শুরু করে সেচ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়া এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র ও কারখানাগুলোর শীতল থাকা কঠিন হয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে পরিবহন নেটওয়ার্কগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে এবং শ্রমিকের উৎপাদনশীলতাও কমে যাচ্ছে।

লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের গ্রান্থাম রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্টের নীতি ও যোগাযোগ পরিচালক বব ওয়ার্ড বলেন, ‘এই নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা অনেক আগেই এ ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন, আরও তীব্রভাবে সারা বিশ্বজুড়েই এই তাপপ্রবাহ দেখা যাবে’।

চীনের কয়েক ডজন শহরের তাপমাত্রা ইতিমধ্যেই ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) অতিক্রম করেছে। গত ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মুখোমুখি হচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার কিছু অংশ এই সপ্তাহে ৪০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা দেখতে পারে। এবছর গ্রীষ্মের শুরুতেই প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠেছিল।

বিশ্ব অর্থনীতি আগে থেকেই চাপের মধ্যে ছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় ইউরোপ আর্থিক মন্দার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার বাড়ানোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হবে। করোনা ঠেকাতে কঠোর লকডাউন এবং রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ধস নামায় চীনের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে।

চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং এই সপ্তাহে বলেছেন, ‘বর্তমানে, আমরা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সবচেয়ে কঠিন পর্যায়ে আছি’।

 

উদ্বেগের ভিন্ন কারণও রয়েছে

অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের গ্লোবাল ম্যাক্রো রিসার্চের পরিচালক বেন মে বলেছেন, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে আরও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এর একটি প্রধান কারণ মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা কঠিন’।

চীনের সিচুয়ান প্রদেশের যেখানে কারখানাগুলো এই সপ্তাহে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, তা ছিল সেমিকন্ডাক্টর এবং সৌর প্যানেল নির্মাতাদের একটি কেন্দ্র। বিদ্যুৎ সংকট অ্যাপল এর সরবরাহকারী ফক্সকন এবং ইন্টেল সহ বিশ্বের কয়েকটি বড় ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির কারখানাগুলোতে আঘাত হানবে।

সিচুয়ান প্রদেশ চীনের লিথিয়াম খনি শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুও। সেখানকার কারখানাগুলো বন্ধ থাকলে লিথিয়ামের মতো কাঁচামালের দাম বেড়ে যাবে, যা বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির মূল উপাদান।

ইয়াংজি এবং জিয়ালিং নদীর সঙ্গমস্থলে সিচুয়ানের পাশের শহর চংকিংয়েও কারখানাগুলোকে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের জন্য আগামী বুধবার থেকে এক সপ্তাহের জন্য কার্যক্রম স্থগিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যেই চলতি বছরের চীনা অর্থনীতির পূর্বাভাসে নিম্ন প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। নোমুরার বিশ্লেষকরা বৃহস্পতিবার ইঙ্গিত দিয়েছেন, ২০২২ সালে চীনের জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২.৮% কম হতে পারে। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫.৫%। গোল্ডম্যান স্যাকস ৩% কম প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা বলেছে।

জার্মানির রাইন নদীর পানি ইতিমধ্যেই এতোটা নীচে নেমে গেছে যে, জাহাজ চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীটি কয়লা সহ বিভিন্ন রাসায়নিক এবং শস্যের পাশাপাশি নানা পণ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন পথ। অন্যদিকে, শ্রমিক সংকটের কারণে পরিবহনের বিকল্প উপায় খুঁজে পাওয়াও কঠিন। ফলে দেশটি আগামী শীতে বড় ধরনের সংকটে পড়বে।

জার্মান শিল্প ফেডারেশনের ডেপুটি পরিচালক হোলগার লোশ এই সপ্তাহে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘রাসায়নিক বা ইস্পাত শিল্পের প্ল্যান্টগুলো বন্ধ হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। কারণ খনিজ তেল এবং নির্মাণ সামগ্রী তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না এবং বড় আয়তনের এবং ভারী পরিবহন আর চালানো যাচ্ছে না’।

রাইন নদীর পানি কমে যাওয়ায় ২০১৮ সালে জার্মানির অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রায় ০.৩ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু সেসময় সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত কম পানির সমস্যা ছিল না। কিন্তু এবার পানি অনেক কম আছে। ফলে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে জিডিপি কমপক্ষে ০.৫ শতাংশ কম হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং জার্মানি আর্থিক মন্দার কবলে পড়তে পারে।

আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে নজিরবিহীন খরায় দেশটির বৃহত্তম জলাধারগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। যা ফেডারেল সরকারের পানি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। কৃষকদের ফসলও নষ্ট করছে।

বীমা কোম্পানি এবং কৃষি স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী লবিং গ্রুপ আমেরিকান ফার্ম ব্যুরো ফেডারেশন এর এক সমীক্ষা অনুসারে, মার্কিন কৃষকদের প্রায় তিন চতুর্থাংশ বলেছেন, এই বছরের খরা তাদের ফসলের ক্ষতি করছে- উল্লেখযোগ্য ফসল এবং আয়ের ক্ষতির সাথে।

টেক্সাস থেকে উত্তর ডাকোটা এবং ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত চরম খরা অঞ্চলে গত ৮ জুন থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত ১৫টি রাজ্যজুড়ে সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়েছিল। ওই অঞ্চলে দেশটির কৃষি উৎপাদনের অর্ধেক হয়। ফল এবং বাদাম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ক্যালিফোর্নিয়ার ৫০% কৃষক বলেছেন, খরার কারণে তাদের অনেক ফল গাছ এবং বহু বছরীয় ফসল নষ্ট হয়েছে। যা ভবিষ্যত রাজস্বের ওপর প্রভাব ফেলবে।

লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এর অর্থনীতিবিদ ওয়ার্ড বলেছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ না করলে খরচ বাড়তেই থাকবে। এমনকি এই তাপপ্রবাহের পর্বগুলো শুধু সময়ের সাথে সাথে আরও বেশি তীব্র এবং ঘন ঘনই হয়ে উঠছে না। বরং হঠাৎ করেই তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে যাচ্ছে। তার মানে এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া আরও কঠিন হবে’।

সূত্র: সিএনএন

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments