Monday, April 21, 2025
HomeScrollingধার-দেনায় চলছে সংসার, ভালো নেই নিম্ন আয়ের মানুষ

ধার-দেনায় চলছে সংসার, ভালো নেই নিম্ন আয়ের মানুষ

দ্রব্যমূল্যের চাপে অনেককেই ধার-দেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে। কেউ কেউ খরচ কমাতে স্ত্রী সন্তানকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপরও সংসার চালাতে পারছেন না। একজন প্রাইভেট কার চালকের কথা, ‘স্ত্রী সন্তানকে বাড়ি না পাঠালে ছিনতাই, ডাকাতি করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তারপরও চলতে পারছি না।’

ডিমের ডজন ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা হয়েছিল সপ্তাহখানেক আগে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারত থেকে ডিম আমদানি করা হয়। অভিযানও চালানো হয়। ন্যায্য মূল্যে ডিম বিতরণ করা হয়। তারপর ডিমের ডজন ১৬০ টাকায় নেমে আসে৷ তবে আজ (শুক্রবার) দাম আবার ১৬৫ টাকায় উঠেছে।

সরকার গত ১৫ অক্টোবর ডিমের যে দাম বেঁধে দিয়েছে, তাতে এক ডজন ডিমের দাম কোনোভাবেই ১৪৪ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এখন ক্রেতাদের কাছ থেকে তার চেয়ে ডজনে ২০-২১ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে জানতে চাইলে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ‘করপোরেট ও তেজগাঁও সিন্ডিকেটই এর জন্য দায়ী। তারাই ডিমের দাম  বাস্তবে নির্ধারণ করে দেয়। সরকারি দাম তারা তোয়াক্কা করে না। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আগের সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, বর্তমান সরকারও ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’

তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘সরকার ডিমের দাম বেঁধে দেওয়ার পর ওই সিন্ডিকেট আবার মুরগির বাচ্চা ও ফিডের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে চাপ সৃষ্টি করছে।’

বাজার পরিস্থিতি

পেঁপে, বেগুন আর বরবটি ছাড়া বেশির ভাগ সবজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে। বেড়েছে পেঁয়াজ ও আলুর দাম। সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। ৯০ টাকার পেঁয়াজ এখন ১১০ টাকা, ২০০ টাকা কেজির বেগুন ২২০ টাকা, ৫৫ টাকার আলু বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়।

৭০০ টাকার নিচে মাছ নেই। মুরগির দামও বেড়েছে। ব্রয়লারের কেজি ২২০ টাকা, সোনালী ৩০০ টাকা, ডিমের ডজন ১৬৫ টাকা, গরুর মাংসের কেজি ৭৫০ টাকা।

কলাবাগানের সবজি বিক্রেতা রুবেল মিয়া জানান, ‘কিছু কিছু সবজির দাম কমলেও বেশ কিছু শাক-সবজির দাম আবার বেড়েছে। একটার দাম একটু কমে তো আরেবটার দাম বাড়ে। আমরা বেশি দামে কিনি, তাই বেশি দামে বিক্রি করি। আমাদের কিছু করার নাই।’

কাওয়ান বাজারে কথা হয় একজন ক্রেতা আবু সালেহর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের দামের যে তালিকা টানানো হয়, সেই দামে কেনা পণ্য পাওয়া যায় না। যখন অভিযান চলে, সেই সময়ে তারা কিছুটা কম দামে বিক্রি করে। টিম চলে গেলে আবার দাম বাড়িয়ে দেয়। টেলিভিশন ক্যামেরা গেলে তারা দাম কমিয়ে বলে।’

এক বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক মাহিয়া ইসলাম দ্রব্যমূল্য সম্পর্কে বলেন, ‘শুক্রবার আমার কাছে কারওয়ান বাজারে কাঁচামরিচের কেজি বলা হয়েছে ২৪০ টাকা। আমি ক্যামেরা রেখে ক্রেতা সেজে আরেক দোকানে গিয়ে দাম জানতে চাইলে এক কেজির দাম চায় ৩২০ টাকা।’

কেমন আছেন নিম্ন আয়ের মানুষ?

মো. মুকুল মোল্লা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালকের চাকরি করেন। মাসে সর্বসাকুল্যে বেতন পান ২১ হাজার ৫০০ টাকা। দুই সন্তান, মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে তার পাঁচজনের সংসার। তিনি ঢাকার কলাবাগানে একটি মেসে থাকেন। আর পরিবারের সদস্যরা থাকেন তার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে।

তার যে আয় তার মধ্যে ১০ হাজার টাকা খরচ হয় কলাবাগানের মেসের ভাড়া এবং খাওয়ায়৷ দুই-তিন হাজার টাকা হাত খরচ বাবদ রেখে বাকি সাত-আট হাজার টাকা গ্রামের বাড়িতে পাঠান। কিন্তু সেই টাকায় তাদের চলে না। প্রতিমাসেই পাঁচ-ছয় হাজার টাকা ঋণ করতে হয়। তার কথা, ‘আমি এখন ঋণে ডুবে যাচ্ছি। আগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তি ছিল। এখন আরো বাড়ছে। ছেলে-মেয়েদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারি না। এক মাসেও একবার গরুর মাংস খেতে পায় না তারা। ব্রয়লার মুরগিরও দাম বেশি। ডিমের দাম বেশি হলেও সপ্তাহে একদিন খেতে পারি। দুধের কথা চিন্তাও করতে পারি না।’

‘বাজারের যে কী অবস্থা তা বলার ভাষা নাই। আমরা যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাদের এখন টিকে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। আর তার মধ্যে বাচ্চাদের লেখাপড়া আছে। একটা পুরণ হয় তো আরেকটায় টান পড়ে। অসুখ-বিসুখ হলে তো রীতিমতো ভিক্ষা করতে হয়। ধারের ওপরে ধার,’ বলেন তিনি।

তার কথা, ‘আমার ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী ও মা-কে যদি গ্রামের বাড়িতে না রেখে ঢাকায় রাখতে হতো, তাহলে চুরি, ছিনতাই বা ডাকাতি করা ছাড়া আর কোনো পথ থাকতো না।’

BB1

একই পরিস্থিতির শিকার দিলদার সিকদার। তিনি ঢাকার একটি প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিতে কাজ করেন। বেতন পান ১৬ হাজার টাকা। স্ত্রী ও মা-কে নিয়ে তার সংসার। তিনি বলেন, ‘আমার যা আয় হয় তাই ব্যয়। হাতে কোনো টাকা থাকে না। যা আয় করি তাই দিয়ে কোনোমতে সংসার চালাই। তবে এখন সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। গত মাসে মাত্র একবার মাংস খেয়েছি। এই মাসে খাই নাই। শাক-সবজি খেয়েও বাঁচার উপায় নাই। কারণ, তার দামও  বাড়তি। ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি নাই। সামনের দিনগুলোতে যে কীভাবে চলবো বুঝে উঠতে পারছি না। কোম্পানিও বেতন বাড়াতে পারবে না বলে দিয়েছে। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎও নাই, পরিকল্পনাও নাই।’

রিকশা চালক ইউসুফ হোসেন এরইমধ্যে ৭০ হাজার টাকা ঋণ করে ফেলেছেন। তার কথা, ‘ছয় মাসের মধ্যে আমাকে এই ঋণ শোধ করতে হবে। আশা করি, শীতকালে ট্রিপ বাড়বে, আয়ও বাড়বে৷ তখন কিছু ঋণ শোধ করতে পারবো।’

ছয়জনের সংসার তার । প্রতিদিন ছয়-সাতশ’ টাকা গড়ে আয় করেন তিনি। মাসে ১৬-১৭ হাজার টাকা। এই টাকায় পরিবারের খরচ মিটানো সম্ভব নয়। তাই খরচ কমাতে পরিবারের সবাইকে গ্রামের বাড়ি নাটোর পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপরও কুলোতে পারেন না। তার একারই মাসে মেস ভাড়াসহ সব মিলিয়ে খরচ হয় ১০-১২ হাজার টাকা। তাই প্রতিমাসেই ঋণ করতে হয়।

‘গরুর মাংস খেয়েছি গত কোরবানির ঈদে। তারপর আর খাইনি। শাক-সবজি, ডিম, মাছ মাংস সব কিছুর দামই বেশি। কম খেয়ে থাকতে হয় এখন,’ বলেন তিনি।

সরকারের তৎপরতা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ৫৮ জন কর্মকর্তার নেতৃত্বে দেশব্যাপী অভিযান শুরু করেছে ভোক্তা অধিদফতর। তাতে বাজারে বিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও সিন্ডিকেট এখনো সক্রিয় বলে জানান কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষ অনেক কষ্টে আছে। অনেকে কম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন।’

‘নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু নানা সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে তারা  মাঝখান থেকে দাম বাড়িয়ে মুনাফা করছে বিভিন্ন পণ্যে। এখানে উৎপাদকরা তেমন কিছু পাচ্ছেন না। সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও ইতিবাচক ফল পা ওয়া যাবে না,’ বলেন তিনি।

প্রতিযোগিতা কমিশন জানায়, তারা এ পর্যন্ত সাধারণ চাল ও করপোরেট চালে ২০টি, ভোজ্যতেলে ৯ টি, ডিম নিয়ে কারসাজি করায় ১৭টি, মুরগি সিন্ডিকেট নয়টি, পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একটিসহ বিভিন্ন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ১২০টি মামলা করেছে। তারপরও সিন্ডিকেটের কারসাজি কমছে না।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের পরিচালক ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন বলেন, ‘বাজারে বিভিন্ন পণ্যের অদৃশ্য সিন্ডিকেটও আছে। তাদের অনেক সময় চিহ্নিত করা যায় না। কারণ, তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট লোকেশন বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নাই৷ তারা ফোন এবং অনলাইনে সিন্ডিকেটবাজি করে। ফলে ডিমসহ যেসব পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেই দামে বাজারে পণ্য পাওয়া যায় না। এটা কঠিন। আমরা এরই মধ্যে ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতদের এক অংশকে চিহ্নিত করেছি। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘প্রতি জেলায় জেলায় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অভিযানের পাশাপাশি আমরা পণ্যের সরবরাহ লাইন নিরবচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করছি। শুধু অভিযানে কাজ হয় না। সরবরাহ লাইন ঠিক না থাকলে বাজারে নতুন করে সংকট তৈরি হতে পারে,’ বলেন তিনি।

info-ডয়চে ভেলে

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments