আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর নানা দাবি নিয়ে রাজপথে নামছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। এসব দাবিকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে খণ্ড খণ্ড আন্দোলন। রাজধানী ঢাকা যেন হয়ে উঠেছে দাবি আদায়ের আন্দোলনের শহর। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে চাকরিজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রিকশাচালক সবাই দাবি আদায়ের চেষ্টায় তৎপর।
আজ বুধবার (২৮ আগস্ট) থেকে গণছুটিতে যাওয়ার কথা পল্লী বিদ্যুতের কর্মচারীদের।
সোমবার প্যাডেল-চালিত রিকশার চালকরা তাদের এক দফা দাবি আদায়ে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে শাহবাগ ছাড়েন । তাদের একটাই দাবি- শহরের মূল সড়কে ইঞ্জিন-চালিত রিকশা চলতে পারবে না।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ মাঠে নামতে থাকে। অনেকেই তাদের দাবি নিয়ে সচিবালয় এলাকা এবং মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ‘যমুনা’র সামনে অবস্থান নেন।
রোববার রাতে সচিবালয়ে আনসারদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সচিবালয় ও আশপাশের এলাকা এবং প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন এলাকায় কোনো ধরনের সভা সমাবেশ, মিছিল ও জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে। তবে সরকার নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাবি-দাওয়া পেশের কথা বলেছে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া আনসার সদস্য নাসির আহমেদ বলেন, আমরা আমাদের কর্মস্থলে ফিরে গেলেও এখন গ্রেফতার আতঙ্কে আছি। কাকে কখন গ্রেফতার করা হয় জানি না। মামলাও হচ্ছে।
তার কথা, ‘আমরা যারা সাধারণ নিরস্ত্র আনসার আছি, আমাদের মাসিক বেতন ১৬ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু আমরা নিয়মিত নই। বছরের সব সময় আমাদের কাজ থাকে না। ফলে যখন কাজ থাকে তখন বেতন পাই। আর এই বেতনে পরিবার নিয়ে চলা অসম্ভব। সারা বছর এই বেতন পেলেও তবু কথা ছিল। এখন আমাদের দাবি আর পূরণ হবে কিনা জনি না। আমরা দাবি করেছিলাম আমাদের চাকরি যেন জাতীয়করণ করা হয়। তাহলে আমাদের একটা বেতন-কাঠামো হতো। সারাবছর বেতন পেতাম।’
বিভিন্ন সরকারি দফতরে কর্মকর্তাদের গাড়ি-চালক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া অনেকে দৈনিক ভিত্তিতে মজুরি পান। তাদের মাস ২৭ দিনে, সেই হিসাবে তারা প্রতিদিন ৫৫০ টাকা করে মজুরি পান। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এইরকম মাস্টাররোলে নিয়োগ পাওয়া চালকরাও তাদের স্থায়ী করার দাবি নিয়ে ঢাকায় সমবেত হয়েছিলেন। তাদেরই একজন সিরাজুল ইসলাম শামীম। তিনি বলেন, আমরা বছরের পর বছর ঝুলে আছি। আমাদের চাকরি স্থায়ী করা হয় না। আমরা প্রধান উপদেষ্টার দফতরে আমাদের দাবি লিখিতভাবে জমা দিয়েছি। দেখি কী হয়।
তার কথা, ‘আমরা কোনো বোনাস বা ভাতাও পাই না। অসুস্থতার কারণে গাড়ি চালাতে না পারলে ওই দিনের মজুরি পাই না।’
ঢাকায় বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ওয়াসা, ডেসা, সচিবালয় কর্মচারি থেকে বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দাবি নিয়ে মাঠে আছেন। তাদের প্রধান অসন্তোষের কারণ, পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়া, চাকরি স্থায়ী না করা। আবার যারা বিভিন্ন সময় চাকরিচ্যুত হয়েছেন তারাও চাকরি ফিরে পেতে মাঠে নেমেছেন।
বাংলাদেশ বেতারের কয়েকজন কর্মচারী জানান, তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছেন ১০-১২ বছর ধরে। রাজনৈতিক কারণে তাদের স্থায়ী করা হয়নি। যারা আওয়ামী লীগ করতেন, তারাই এতদিন স্থায়ী হয়েছেন বলেও দাবি তাদের।
বেতারের একজন কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ১২ বছর আগে বিসিএস তথ্য ক্যাডারে যোগ দিয়ে এখনো পদোন্নতি পাইনি। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে কেউ কেউ এরই মধ্যে উপ-সচিব হয়েছে। আমরা এই ক্যাডার-বৈষম্যের অবসান চাই।
গ্রাম পুলিশরাও ঢাকায় এসেছিলেন ১৮ আগস্ট। তারাও তাদের চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে সমবেত হন। তাদের কথা তাদের মাসিক বেতন ছয় হাজার ৫০০ টাকা। এই বেতনে তাদের সংসার চলে না। আর এই বেতনও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়ার কারণে তাদের অনেক বেতন বকেয়া পড়ে আছে। চাকরি জাতীয়করণ ও বেতন স্কেলের দাবি জানান তারা।
দাবি আদায়ে আর কেউ সফল না হলেও শিক্ষার্থীদের একাংশ পুরোপুরি সফল। আন্দোলন করে এইচএসসি পরীক্ষার অবশিষ্ট ছয় বিষয়ের পরীক্ষা ইতোমধ্যে বাতিল করে নিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তারা ২০ আগস্ট একযোগে সচিবালয়ে ঢুকে শিক্ষা উপদেষ্টাকে ঘেরাও করে তাদের দাবি আদায় করে নেয়। এখন শিক্ষার্থীদের আরেক অংশ এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন করছেন।
বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও দাবি আদায়ের আন্দোলনে আছেন। আন্দোলনে আছেন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরাও।
শাহবাগ এখন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানানোর বড় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে প্রতিদিনই কোনো-না-কোনো গ্রুপ তাদের দাবি নিয়ে সমবেত হচ্ছে। প্যাডেল-চালিত রিকশাচালকরা সোমবার শাহবাগে বড় সমাবেশ করেছেন। তাদের দাবি- ঢাকার মূল সড়কে ইঞ্জিন-চালিত রিকশা চলতে পারবে না, কারণ, ইঞ্জিন-চালিত রিকশা চললে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আন্দোলনকারী রিকশাচালক আবদুল হক বলেন, ইঞ্জিন রিকশার কোনো বৈধতা নাই। তারপরও আগের সরকার তাদের এলাকাভিত্তিক গলিতে চলতে দিতো। কিন্তু তারা এখন মূল সড়কে উঠে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যায়। এতে আমরা প্যাডেল চালিতরা ক্ষতির মুখে পড়ছি। আমাদের যাত্রী কমে গেছে।
আন্দোলনকারীরা সরকারকে ৭২ ঘণ্টা সময় দিয়েছে। এর মধ্যে ইঞ্জিনচালিত রিকশা মূল সড়কে চলা বন্ধ না হলে তারাই অ্যাকশনে গিয়ে ওইসব রিকশা ভেঙে ফেলবে বলে জানিয়েছে।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন বেতন কমানোর আন্দোলন চলছে। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ অন্যদের পদত্যাগের দাবিও জানাচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রুপ। কাউকে আবার জোর করে পদত্যাগও করানো হচ্ছে। দেশের ৪৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন ভিসি নেই। তারা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে একীভূত করার দাবিতে আল্টিমেটাম দিয়েছে সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পাশাপাশি অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়ন, চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিত কর্মচারীদের চাকরি নিয়মিতকরণের দাবি জানিয়েছেন তারা। এজন্য কর্তৃপক্ষকে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন ৮০ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবি পূরণ না হলে, বুধবার থেকে স্টেশন ত্যাগ করে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণছুটির কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
যারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠে আছেন, তারা সবাই বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে কাজ করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামের সাথে মিল রেখে তারাও তাদের সংগঠনের নাম রেখেছেন।
মানবাধিকার কর্মী ও আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, যারা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন তাদের দাবির যৌক্তিকতা আছে। আসলে গত ১৫ বছরে অনেক বৈষম্য এবং অনিয়মের কারণে অনেকেই বঞ্চিত হয়েছে। তারা মনে করছেন, এখনই সময় এই বৈষম্য অবসানের। কিন্তু তারা এই দাবি জানাতে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পথে না গিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করছেন। সচিবালয়ে ঢুকে পড়ছেন, ঘেরাও করছেন, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে বসে পড়ছেন। ঢাকার রাস্তা-ঘাট দখল করে আন্দোলন করতে গিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে হয় যেসব যৌক্তিক দাবির সঙ্গে অর্থ খরচের বিষয় নেই। সেই দাবি সরকার এখনই মেনে নিতে পারে। আর যার সঙ্গে রাজস্ব খাত জড়িত, তা সরকার তার সক্ষমতা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে পূরণ করতে পারে। তবে দাবি পেশ করতে হবে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। আর এই দাবির বিষয়ে শোনার জন্য সরকারকেও একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বের করতে হবে।
এই সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এরই মধ্যে প্রশাসন ও পুলিশসহ বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক পদোন্নতি এবং পদায়নের কাজ করেছে। আর সেটা ধারাবাহিকভাবে চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, যাদের পদোন্নতি এবং পদায়ন করা হয়েছে, আসলেই তারা বঞ্চিত ছিলেন। আর আমি মনে করি, আরো যেসব দাবি উঠছে তার মধ্যে ৮০ ভাগই যৌক্তিক দাবি। তারা মনে করছেন, এখন যদি তাদের দাবি পূরণ না হয়, পরে হয়তো আর হবে না। তাই তারা চাইছেন এই সময়ে তাদের দাবি আদায় করতে তাই তারা মাঠে নেমেছেন।
তার কথা, বিষয়গুলো সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। আর সরকারকেও সময় দিতে হবে। সব দাবি সরকার একবারে পূরণ করতে পারবে না। আর যারা তাদের দাবি তুলছেন তাদেরও বিবেচনা করতে হবে যে সরকার এখনই সব যৌক্তিক দাবি পূরণ করতে পারবে কিনা। উভয় পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে।