অনেক কিছুই স্মৃতিতে আছে আবার অনেক কিছু ভুলেও গেছি। ষাটের দশকে স্বাধীনতা-স্বাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মুজিব ভাই। নিজের আত্মত্যাগ, দক্ষতা-যোগ্যতায় সেই সময়ের অনেক নেতাকে ছাপিয়ে স্বপ্নের নায়ক হয়ে ওঠেন মুজিব ভাই। ৩৫ বার জেল খেটেছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছি তেজোদ্দীপ্ত বিশাল মাপের মানুষ মুজিব ভাইকে। পাকিস্তানের বৈরী এবং বন্ধুর পরিবেশে তিনি ছিলেন সবার নির্ভরতার কান্ডারি, বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। দলীয় নেতার পরিচয় অতিক্রম করে তিনি দলের সীমা-পরিসীমা মাড়িয়ে সবার পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। আমাদের মতো মাঠকর্মীরা বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন ও সুভাষ বসুকে দেখিনি। কিন্তু তাদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা তাকে ঘিরে আবর্তিত হতো সেই দিনগুলোতে। গণতন্ত্র, বাঙালিত্ব, অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজের জন্য আন্দোলন সংগ্রামে সেদিন দলমত নির্বিশেষে কর্মী বাহিনীর কাছে তিনি প্রকৃত জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তার অনন্য সাধারণ সাহস জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা, দুঃসহ কষ্ট ও কারা যন্ত্রণা ভোগ করে ও ত্যাগের নজির হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে মুজিব ভাই জনমনে হিমালয়ের উচ্চতা অর্জন করেছেন। এমনকি ভিন্নমতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার উষ্ণ আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ঈর্ষণীয়। এখন মনে হয় যেন তিনি এক একান্নবর্তী রাজনৈতিক পরিবারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন সেই দিনগুলোতে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী বাম প্রগতিশীল দলের কর্মীবাহিনী মুজিব ভাইয়ের কাছে পেতেন অঢেল স্নেহ, ভালোবাসা, অফুরন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা। আজ কল্পনা করতেও কষ্ট হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কত মানবিক কত সমন্বিত কত উচ্চ এবং উন্নত স্তরে ছিল সেই দিনগুলোতে। এই স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে আমি বলব, জাতীয় কর্তব্য পালনের অঙ্গ হিসেবে আজ অনেকেই তাকে ব্যবহার করছেন দলীয় বিবেচনায়। কেউবা অতি মানব হিসেবে চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক স্বার্থ উদ্ধারের কারণে তাকে ব্যবহার করছেন। অথবা রাজনৈতিক বৈরিতায় তাকে খাটো করার যে প্রয়াস বর্তমানে চলছে ইতিহাস তা মেনে নেবে না, মানতে পারে না। ১৯৬৩ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন এবং ছাত্র আন্দোলনে পরামর্শ এবং আর্থিক সহায়তার জন্য মুজিব ভাইয়ের কাছে একাধিকবার গিয়েছি ৩২ নম্বরের বাসভবনে। কখনো রেজা আলী, সাইফুদ্দিন মানিক এবং প্রকৌশলী গোলাম মর্তুজা তাদের সঙ্গে। আন্তরিকতায় সিক্ত তার পরামর্শ-সহযোগিতা সবসময়ই পেয়েছি। নিজের কর্মীদের জন্য সংগৃহীত, সীমিত সঞ্চয়ের মধ্য থেকে তিনি আমাদের বড় অনুষ্ঠানের জন্য হাজার টাকাও দিয়েছেন। এমনকি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে তিনি আমাদের পাঠাতেন অধিক অর্থের প্রয়োজনে। একাধিকবার দেখেছি মফস্বল থেকে আসা আওয়ামী লীগের গরিব ও নিঃস্ব এবং মধ্যবিত্ত কর্মীরা নেতার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তাদের তিনি মধুর ব্যবহারে তুষ্ট করে সংগঠন ও আন্দোলনের কাজে জোরদারভাবে নামতে উৎসাহিত করতেন। বিদায়ের আগে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে পকেটে ভরে দিতেন একটি হোমিওপ্যাথিক পুরিয়ার মতো জিনিস। পরে মুজিব ভাইকে প্রশ্ন করে জেনেছি গরিব কর্মীরা কষ্ট করে ঢাকায় আসে তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করতে তিনি পঞ্চাশ, একশো এবং দুশো টাকার পুরিয়া বানিয়ে জমা রাখতেন। সেদিনকার সংগ্রাম ও আন্দোলনের কাজে ওই পরিমাণ আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যেত নেতার কাছ থেকে যা ছিল উদ্দীপনার রসদ। আজকের বাস্তবতায় এই নজির কল্পকাহিনীর মতো শোনাবে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ছিল। সময়ে সময়ে তীব্র বৈরিতাও হয়েছে। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে ৬ দফা ও ১১ দফা গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর ক্ষেত্রে অবিচ্ছিন্ন-ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ অব্যাহত থাকার পশ্চাতে ছিল মুজিব ভাইয়ের দূরদর্শী রাজনৈতিক লক্ষ্যসীমা ও তাগিদ। এই কাজে মণিসিংহ, মোজাফ্ফর আহমেদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, পীর হাবিবুর রহমান, খোকা রায়, মো. ফরহাদ, মানিক মিয়া, মিজানুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও শহীদুল্লা কায়সার পালন করতেন যথাযোগ্য, পরিপূরক ও সম্পূরক ভূমিকা। পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল স্বৈরাচারী সরকার পূর্ব বাংলার বিশেষত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, খুলনা প্রভৃতি অঞ্চলে ১৯৬৪ সালে ১৪ জানুয়ারি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উসকে দেয়। কাশ্মীরে হযরতবাল মসজিদে পয়গম্বরের রক্ষিত পবিত্র চুল চুরির প্রতিক্রিয়ায় পূর্ববঙ্গে এই দাঙ্গা রটায় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে ভয়ার্ত-উদ্বাস্তু নর-নারী-শিশুরা আশ্রয় গ্রহণ করেছিল মাসাধিককাল আজও তিনিই নায়ক ধরে। তখন জগন্নাথ হলে ছাত্রদের উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সংসদ ভবনে একটি আশ্রয় শিবির স্থাপিত হয়। দুই হাজারের বেশি শরণার্থীর খাদ্য ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য ও মহিউদ্দিন আহমেদ মুজিব ভাইয়ের কাছে চাল-ডাল, লণ্ঠনসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি চেয়ে পত্রবাহক আখলাকুর রহমানকে পাঠিয়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাঁচ বস্তা চাল, এক বস্তা ডাল দুই হাজার টাকা পাঠান মুজিব ভাই। পরের দিন মহিউদ্দিন ভাইও পাঠান প্রায় কাছাকাছি পরিমাণ সাহায্য সামগ্রী।
১৯৬৭ সালের ১৭ অক্টোবর আমি গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদের শিকার হই। আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বাধীনবাংলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত করে জেলখানায় পাঠানো হয়। কারাগারে ঢুকেই দেখি কারাগার হাসপাতালে অপেক্ষা করেছেন মুজিব ভাই। জিজ্ঞাসাবাদের বিস্তারিত বিষয় তাকে জানালাম। যার সিংহভাগই ছিল মুজিব ভাইয়ের বিরুদ্ধে। মানিক চৌধুরী, বিধান কৃষ্ণ সেন, চট্টগ্রামের ডা. জাফর, হান্নান সাহেব, একে খান প্রমুখের সঙ্গে শেখ মুজিবের বৈঠক ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আমাকে। পাশাপাশি কয়েকজন সেনা অফিসারের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গও ছিল ওই জিজ্ঞাসাবাদে। যা হোক ’৬৭ সালের অক্টোবরের ২০ তারিখে আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিই এই মর্মে যে, সেনা আমলা যুক্ত হয়ে মুজিব ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র মামলা তৈরি করা হচ্ছে যা পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে খ্যাতি পায়। কারাগারে অবস্থানকালে ওই সময় আমি ১৯দিন মুজিব ভাইয়ের সান্নিধ্যে ছিলাম। তিনি দেওয়ানি নামক একটি কক্ষে থাকতেন তার বিপরীত দিকে ২০ নম্বর সেল নামক একটি সেলে আমাকে রাখা হয়েছে। পরে জেনেছি উনিই সেই ব্যবস্থা করেছিলেন জেল কর্র্তৃপক্ষকে বলে। উনি তার পাশেই আমাকে রাখতে চেয়েছেন। সেই সময়ে বহু ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। পারিবারিক, সংসার, তার জীবন সংগ্রাম বহু বিষয়ে। ঠাট্টার ছলে অনেক কথা তুলে ধরতেন। সেই সময়ে কথা প্রসঙ্গে একবার মুজিব ভাইকে একটা বইয়ের কথা বলেছিলাম। বইটির নাম অ্যান অ্যাকাডেমিকাল স্টাডি অব পাকিস্তান। বইটির লেখক ছিলেন অধ্যাপক গনোকভস্কি। সোভিয়েত ইউনিয়নের। যে গ্রন্থে পাকিস্তানের জাতিসমূহের বিশেষত বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রশ্নের দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে রক্তাক্ত পরিসমাপ্তি ঘটবে বলে ভাষ্য দেওয়া ছিল। কবি জসীম উদ্দীন এই বইটি রাশিয়া থেকে নিয়ে আসেন। তার পুত্র জামাল আনোয়ার বাসুর বন্ধুদের কাছ থেকে বইটি নিয়ে আমি পড়ার সুযোগ পাই। মুজিব ভাই এই তথ্যটি নিয়ে একাধিকবার তর্ক করেন এই মর্মে যে, প্রচ- জনমত সৃষ্টি হলে শাসক গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চাপে ৬ দফা মেনে নিতে বাধ্য হবে। তাছাড়া সশস্ত্র যুদ্ধের পার্টি তো আওয়ামী লীগ নয়, এমনকি ন্যাপও নয়। অবশ্য সে কথাও তিনি বলেছিলেন সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে। তবে আমি হিসাব করে দেখেছি ২৭ জনের বেশি লোক পাব না। সম্ভাব্যদের মধ্যে তৎকালীন ছাত্রনেতাদের নাম তিনি বলেছিলেন। এরমধ্যে বিভিন্ন জেলার সার্বক্ষণিক কিছু কর্মীর নাম তিনি বলেছিলেন। যাদের মধ্যে একজন ছিলেন সন্দ্বীপের লোক সম্ভবত আবদুর রহমান বয়াতি। যিনি ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় জনসভার আগে লোকগান পরিবেশন করে জনগণকে মাতিয়ে তুলতেন। যাক আমার জামিনে মুক্ত হওয়ার দিনে তিনি আমাকে জেলগেট পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন। কানে কানে এসে বলেছিলেন মামাকে (শহীদুল্লা কায়সার) দিয়ে বইটা পাঠিয়ে দিস। এই কথা বলে জেলগেটের সামনে এসে তিনি তৎকালীন ডেপুটি জেলার নির্মল সিনহাকে বলেন, আমার ছোট ভাই জেল থেকে জামিনে বাইরে যাচ্ছে তাকে মুক্ত করে দিতে আমি সঙ্গে এসেছি। খিড়কি দরজা দিয়ে সে যাবে না। মূল ফটক খুলে দাও। উচ্চৈঃস্বরে তিনি এ কথা বললেন। নির্মল সিনহা এসে জমাদারকে বললেন, মূল ফটক খুলে দাও। তারপর বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে বেলী ফুলের একটা মালা আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। আমার জীবনের সর্বশেষ সংবর্ধনা আমি পেয়েছি সেদিন। এবং মূল ফটক দিয়ে আমি জেল থেকে বেরিয়েছি। বঙ্গবন্ধু ঠাট্টা করে বললেন আমি পাইপটা মুখে দিয়ে জেলে ঢুকি। আমি খিড়কি দরজা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকি না। মাধা উঁচু করে জেলে ঢুকি, মাথা উঁচু করে জেল থেকে বের হই। এই কথা এখনো কানে বাজে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে বিশ্বজয়ী তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১২ জানুয়ারি তাকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলাম। তিনি আবেগ-আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন, রাশিয়ান বইটা তো দিলি না। বইয়ের কথা অনুযায়ী কাজ তো করেছি। কী বলিস? অবাক হলাম মুজিব ভাইয়ের ঈর্ষণীয় স্মরণশক্তির বহর দেখে ও শুনে। একাধারে গর্বিত এবং লজ্জিত হলাম। অথচ ঘটনাটি ভুলেই গিয়েছিলাম বলা চলে। ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করি। তখন জাতীয়করণকৃত জুট মিলগুলোতে সাবেক মালিকদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সাবেক মালিকরা ১৮টি মিলের যাবতীয় অর্থ একই দিনে তুলে নিয়ে মিলগুলোকে দেউলিয়া করার উদ্যোগ নেন। এই সংবাদ আগের রাতে পেয়ে তৎকালীন পিএস ফরাসউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে বলি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে। পরের দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে জুট মিলের অ্যাকাউন্ট খোয়া যাবে, উঠিয়ে নেবে সাবেক মালিকরা এই কথা বলাতে তিনি আর কাউকে জিজ্ঞাসা না করে সরাসরি ডিসিকে টেলিফোন করে ওই জুটমিলগুলোর সব অ্যাকাউন্ট জব্দ করার ব্যবস্থা করেন।
১৯৭৪ সালে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপসহ বিভিন্ন কারণে তার সঙ্গে বহুবার সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের সুযোগ পেয়েছি। সারা জীবন তার সান্নিধ্য-সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ করেছে স্মৃতির ভান্ডার। সর্বশেষ সাক্ষাৎ করি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ১২ জুলাই। তৎকালীন বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন বরিস বায়েজডিগ। তিনি হিটলারের বন্দিশিবিরে অত্যাচারিত মানুষ। বঙ্গবন্ধু হত্যাসহ মধ্যম পর্যায়ের একটি সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা অচিরেই ঘটতে পারে বলে সংবাদটি তিনি আমাকে জানান ১১ জুলাই। আমি সেই ঘটনা শুনে তাকে বললাম আমার করণীয় কী? তিনি বললেন, আপনি আপনার রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি জানান উপযুক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করার জন্য। আমি সেই কথা কিছু সুপারিশসহ বঙ্গবন্ধুকে জানাই। তিনি প্রথমে স্বভাবজাত ঔদার্য নিয়ে বিষয়টি হালকাভাবে নেন। বলেন, আমি কিছুই দিতে না পারি ভাত দিতে না পারি, কাপড় দিতে না পারি স্বাধীনতা তো দিয়েছি। আমার বুকে বন্দুক চালাতে ওদের হাত কাঁপবে না? আমার চাপাচাপিতে পরে তিনি বলেন, রক্ষীবাহিনীর প্রধান নুরুজ্জামানকে মার্শাল টিটোর কাছে তিনি পাঠিয়েছেন। অ্যান্টি ট্যাংক গান আনতে । ওই সময়ে ট্যাংক ছিল মিসরের সেনাবাহিনীর। কিন্তু অ্যান্টি ট্যাংক গান ছিল না। সেটা এক মাসের মধ্যে পাওয়া যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এসব আলোচনাকালে একজন ভদ্রলোক একটা ফাইল নিয়ে ঢোকেন। পরে তার পরিচয় জানলাম উনি একজন সাবেক পুলিশ কর্তা ও তৎকালীন সচিব। যিনি আমাকেও ইন্টারোগেশন করেন। তিনি আকস্মিকভাবে ঘরে ঢুকেন একটা ফাইল নিয়ে। আমি বঙ্গবন্ধুর হাঁটুতে চাপ দিয়ে বোঝাই ওই প্রতিষেধক বিষয়টি যেন না বলেন। তিনি হেসে বলেন ও আমার লোক। এ কথা বলে কী ব্যবস্থা এক মাসের মধ্যে নেবেন তা একটু পুনরুক্তি করেন। কথা শেষে যখন বেরিয়ে আসি তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করি আমি যখন জানতে পারি আর কেউ যখন জানতে পারে যে, এক মাসের মধ্যে অ্যান্টি ট্যাংক গান আসবে তাহলে এক মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে হয়তো আমরা হারাব। বিষয়টি অত্যন্ত ত্বরিত জানাই মোজাফ্ফর আহমেদ, কমরেড ফরহাদ ও মণি সিংহকে। সেদিন মুজিব ভাইয়ের কাছ থেকে বেরিয়ে আসার সময় তিনি রসিকতা করে বললেন আমি তোদের বিপদ নিয়ে ভাবি, তোরা সাবধানে থাকিস। আমি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে গলায় চাদরটা ঝুলিয়ে জনতার ভিড়ে হারিয়ে যাব। বিপদ হবে তোদের। রাষ্ট্রপতির অফিস থেকে বের হওয়ার পথে হঠাৎ দেখি হন হন করে খোন্দকার মোশতাক টুপিটা ঠিক করতে করতে ঢুকছেন। বঙ্গবন্ধু রসিকতা করে বললেন কী রিঅ্যাকশনারি নেতা? কেমন আছেন? মোশতাক ত্বরিত জবাব দিলেন, নেতা আমি আপনার জীবদ্দশায় আপনার বিরোধিতা করব না। খুনি মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট ক্ষমতা গ্রহণ করেন। খুনিও তার কথা রেখেছেন। প্রিয় মুজিব ভাই, দেশবাসীর প্রিয় মৃত্যুঞ্জয়ী মৃত্যুহীন চিরভাস্বর হয়ে বাংলার মানুষের অন্তরে। চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। শতবর্ষেও তিনিই আমাদের নায়ক।
লেখক : প্রবীণ রাজনীতিবিদ
সুত্র- দেশরুপা্ন্তর