
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে লড়তে বিএনপি প্রথম দফায় ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে। এতে নতুন মুখের পাশাপাশি অনেক পুরোনো নেতা থাকলেও বাদ পড়েছেন অনেক হেভিওয়েট। এতে কিছু নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
সোমবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ধানের শীষের প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে সাড়ে তিন ঘণ্টার স্থায়ী কমিটির সভায় তা চূড়ান্ত করা হয়।
ঘোষিত তালিকায় দেখা গেছে দলের প্রয়াত ও প্রবীণ নেতাদের সন্তান, স্ত্রীর পাশাপাশি তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতা, সাবেক ছাত্রনেতা, পেশাজীবীকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে বিএনপি।
তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দলের পুরোনোদের সঙ্গে নতুন মুখের ভিড় বেড়েছে। ২০১৮ সালের একাদশ কিংবা আগের সংসদ নির্বাচনগুলোতে দলের প্রার্থী হতে পারেননি এমন ৮১ জনকে এবার ভোটের লড়াইয়ে জায়গা করে দিয়েছে বিএনপি।
ঘোষিত প্রার্থীদের ২৩৭ জনের মধ্যে বেশিরভাগই ২০১৮ সালের নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে লড়েছিলেন; প্রাথমিক বিশ্লেষণে সেই সংখ্যা ১৫১ জনের।
প্রবীণ ও নবীনদের সমন্বয়ে গড়া এই তালিকায় যেমন আছেন সাবেক ছাত্রনেতা, চিকিৎসক নেতা ও প্রবাসী, তেমনি বিএনপির প্রয়াত বা বর্তমান নেতাদের ছেলে-মেয়েরাও ভোটের লড়াইয়ের সংকেত পেয়েছেন।

আবার তৃণমূল থেকে উঠে আসা বেশ কয়েকজন নেতাও জায়গা করে নিয়েছেন প্রার্থী তালিকায়। আছেন বেশ কয়েকজন সাবেক উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানও।
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের তালিকা না দেওয়া ৬৩টি আসনের মধ্যে ৪০টি যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। অবশিষ্ট ২৩টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হবে পরে। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে সমঝোতা হলে আসন বণ্টনের এই হিসাব কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
যে প্রক্রিয়ায় ২৩৭ আসনের প্রার্থী খুঁজে পেল বিএনপি
প্রার্থী চূড়ান্তের আগে বিএনপি একাধিক ধাপে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে। দলীয় সূত্রে জানা যায়, প্রথম ধাপে সারাদেশের ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক অবস্থান ও নির্বাচনী সক্ষমতা যাচাইয়ে তিন দফা জরিপ পরিচালনা করা হয়।
জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির তিন নেতা— নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
ভার্চুয়াল বৈঠক থেকে খসড়া তালিকা
প্রায় এক মাস ধরে এই পাঁচ নেতা ভার্চুয়াল ও সরাসরি বৈঠকের মাধ্যমে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। এসব আলোচনার ভিত্তিতে একটি প্রাথমিক খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়।

জরিপের ফলাফল ও মাঠপর্যায়ের তথ্য যাচাই শেষে ২৬০টি আসনের একটি তালিকা তৈরি হয়, যা সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত স্থায়ী কমিটিতে
সোমবার (৩ নভেম্বর) দুপুর থেকে তিন ঘণ্টা ধরে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ওই তালিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনার পর ২৩৭টি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করা হয়। তবে বাকি ২৩টি আসনে ঐকমত্য না হওয়ায় সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়।
দীর্ঘ পর্যালোচনার পর ঘোষণা
বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা দীর্ঘ পর্যালোচনা করে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছি।
স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা জানান, ঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থীদের তালিকা থেকে পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম।
হেভিওয়েটদের ঠাঁই না হওয়ায় নানা গুঞ্জন
এদিকে ঘোষিত তালিকায় নেই বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার নাম। যদিও এই তালিকা ঘোষণার সময়ই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, এটি দলের প্রাথমিক তালিকা। দল মনে করলে যেকোনো কারণে যেকোনো সংশোধনী আসতে পারে।
ছিটকে পড়েছেন হেভিওয়েটরা!
২৩৭ আসনের ঘোষিত তালিকায় দেখা গেছে, সেখানে নেই স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, বেগম সেলিমা রহমানের নাম। এছাড়া দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী সোহেল, সদ্য মনোনীত যুগ্ম মহাসচিব হুমায়ুন কবীরের নামও নেই।
স্থান পায়নি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আমিনুর রশীদ ইয়াসিন, আসলাম চৌধুরীর নামও। ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপনও নেই প্রার্থী তালিকায়।
বিএনপি থেকে সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন বলে আলোচনায় ছিলেন একাদশ সংসদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সদস্য রুমিন ফারহানা। তবে মনোনয়ন তালিকায় এবার তার নাম দেখা যায়নি।
ঢাকা-১০ আসন থেকে বিগত সময়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন অসীম। এই আসনে একবার প্রার্থী হয়েছিলেন আরেক নেতা রবিউল ইসলাম রবি। তাদের দুই জনের নামও নেই ঘোষিত তালিকায়।
বাদ পড়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর সাবেক এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম। তিনি এর আগে ভোলা-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও এবার ওই আসন থেকে এবার প্রার্থী হয়েছেন যুবদল সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম নয়ন।

মাগুরার একটি আসন থেকে এবার দলীয় মনোনয়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিলেন আলোচিত নেতা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়ন। তবে তিনিও বাদ পড়েছেন এই তালিকা থেকে।
অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পরিবারের সদস্যদের অনেকেই বাদ পড়েছেন মনোনয়ন তালিকা থেকে। দলটির একটি সূত্র জানিয়েছে, আগে থেকে এক পরিবার থেকে একাধিক প্রার্থী না রাখার সিদ্ধান্ত ছিল দলের।
সেই কারণে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের স্ত্রী হাসিনা আহমদ, মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য রুমানা মাহমুদও বাদ পড়েছেন তালিকা থেকে।
এদিকে যেসব আসন থেকে বিএনপির সিনিয়র নেতারা নির্বাচন করতেন, তাদের মৃত্যুজনিত কারণে কয়েকটি আসন থেকে তাদের সন্তান বা স্ত্রীদের এবার দলীয় মনোনয়ন দিয়েছে দলটি।
তৃণমূলে ক্ষোভের আগুন!
মেহেরপুর-২ (গাংনী) আসনে মনোনয়ন না পেয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বঞ্চিত এক নেতার অনুসারীরা। তারা রাস্তার ওপর শুয়ে অবরোধ করেন।
তারা জেলা বিএনপির সভাপতি জাভেদ মাসুদ মিল্টনের সমর্থক ও নেতাকর্মী। এই আসনে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আমজাদ হোসেনকে।
কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে বিএনপির স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য সোহরাব উদ্দিন দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন তার অনুসারী নেতা-কর্মীরা। সোমবার রাত ৯টার দিকে শহরের মজমপুর রেলগেটে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে এ বিক্ষোভ করেন তারা।

কুমিল্লা-৬ (সদর, সদর দক্ষিণ ও সিটি করপোরেশন) আসনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্দোলনে করেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের সমর্থকরা।
সোমবার রাতে নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, পাড়া-মহল্লা থেকে হাজারো নেতাকর্মী কান্দিরপাড়স্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন।
সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় মাদারীপুরের শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করেছেন সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাভলুর কর্মী-সমর্থকরা। এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাভলু বাদ পড়েছেন বলে জানিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রামে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী মনোনয়ন না পাওয়ায় তার অনুসারীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেছে। সোমবার (৩ নভেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন তার অনুসারীরা।
