

ইসলামের ইতিহাসে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সরাসরি সান্নিধ্যে থেকে তাঁরা ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো আত্মস্থ করেছিলেন এবং নিজেদের জীবনকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের জীবনের কিছু ব্যতিক্রমধর্মী আমল এখানে তুলে ধরা হলো, যেগুলো ধর্মীয়, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ—সবদিক থেকে সব মুসলিমের জন্য অনুসরণীয়।
১. আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস ও দৃঢ়তা
সাহাবায়ে কেরামের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুণ ছিল আল্লাহর প্রতি তাঁদের অটল আস্থা ও অদম্য সাহস। তাঁরা জানতেন যে, ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠাই তাঁদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। হজরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন- ‘যে তার স্ত্রীকে বিধবা করতে চায় কিংবা সন্তানদের এতিম করতে চায়, সে যেন আমার পথ অনুসরণ করে।’ (সিরাতু ইবনে হিশাম: ২/১০২; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ৩/২৩৩)। এই ঘটনা তাঁর আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের জ্বলন্ত প্রমাণ।
২. আল্লাহর রাস্তায় অতুলনীয় দানশীলতা
সাহাবিরা রাসুল (স.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী নিজেদের সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করতেন না। তাঁরা মনে করতেন সব সম্পদের মালিক আল্লাহ, এবং মানুষের কাছে তা আমানতস্বরূপ। তাবুকের যুদ্ধের সময় হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁর সমস্ত সম্পদ নিয়ে এসে রাসুল (স.)-এর কাছে পেশ করলে রাসুল (স.) জিজ্ঞাসা করেছিলেন- ‘পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ?’ তিনি উত্তরে বলেছিলেন- ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে রেখে এসেছি।’ (সুনানে তিরমিজি: ৩৬৭৫)
৩. মানুষের জন্য অনুপম ত্যাগ
দুনিয়ার মোহ ও ভোগবাদিতা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সাহাবিরা সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা জানতেন যে, প্রকৃত জীবন হলো আখেরাতের জীবন। হজরত আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) একদল অভাবগ্রস্ত মানুষকে তাঁর পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত খাবার দান করে বলেছিলেন- ‘আমরা যদি নিজেরা গ্রহণ করি, তাহলে অন্যদের কী দেব?’ (তারগিব ওয়াত তারহিব: ২/১০৫; হিলয়াতুল আউলিয়া: ১/৮৬)। এটি তাঁর আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
৪. গভীর সহানুভূতি ও সামাজিক দায়িত্ববোধ
সাহাবিরা পরস্পরের দুঃখ-কষ্টে গভীরভাবে অংশ নিতেন এবং সর্বদা একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) প্রায়ই নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তাঁর খাবার অন্যের সাথে ভাগ করে নিতেন। তিনি বলতেন- ‘সবচেয়ে উত্তম মানুষ হলো যে অন্যদের উপকার করে।’ (ফাতহুল বারি: খণ্ড: ১৪, পৃ. ৩০২; হিলয়াতুল আউলিয়া: খণ্ড: ৪, পৃ. ১৫৬)
৫. নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত-বন্দেগি
সাহাবিরা শুধু ফরজ ইবাদতেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না, বরং নফল ইবাদতের মাধ্যমে সর্বদা আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সচেষ্ট থাকতেন। হজরত উসমান ইবনে আফফান (রা.) এক রাতে নামাজে পূর্ণ কুরআন খতম করতেন। (শরহু ইবনে বাত্তাল: ৩৯০/২)
সাহাবিরা রাতের বেশিরভাগ সময় তাহাজ্জুদ নামাজে কাটাতেন আর বেশি বেশি নফল রোজা রাখতেন। বর্ণিত আছে, হিরাক্লিয়াসের বাহিনী মুসলমানের কাছে পরাজিত হলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের পরাজয়ের কারণ কী? তখন তাদের এক নেতা বলল, কারণ তারা রাতে (তাহাজ্জুদের) নামাজ পড়ে আর দিনে রোজা রাখে। (ইবনে আসাকির, ১/১৪৩)
শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা
সাহাবায়ে কেরামের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি:
- আল্লাহর প্রতি অটল বিশ্বাস রাখা।
- সম্পদে উদারতা দেখানো।
- আত্মসংযম ও ত্যাগের চর্চা করা।
- সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করা।
- ইবাদতে নিষ্ঠা বৃদ্ধি করা।
সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন ইসলামের জীবন্ত আদর্শ। তাঁদের জীবনচরিত আমাদের জন্য অমূল্য পথনির্দেশ। তাঁদের অনুসরণ করে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আত্মিক জীবনকে উন্নত করতে পারি। আসুন আমরা তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার চেষ্টা করি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সাহাবায়ে কেরামের মতো জীবনযাপন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।