গাজা উপত্যকার তিনটি ঐতিহাসিক মসজিদ—ওমরি, ইবনে উসমান ও আল-শামাহ—যেগুলো ইসরায়েলি আগ্রাসনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর পুনর্গঠনের কাজ ২০২৫ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ধীরগতিতেই চলছে। আন্তর্জাতিক সহায়তার অভাব, অব্যাহত অবরোধ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কাজের মূল প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও কিছু অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কিন্তু স্থানীয়দের মতে তা অত্যন্ত ধীর এবং নিরুৎসাহজনক।
ওমরি মসজিদ: নিরাপত্তা ঝুঁকিতে সীমিত অগ্রগতি
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ওমরি মসজিদের পুনরুদ্ধার কাজ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত কাজের ৪৫% সম্পন্ন হয়েছে। ঐতিহাসিক ২৩টি নিদর্শনের মধ্যে ৮টি নতুন করে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তবে মসজিদসংলগ্ন বিস্ফোরক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর ২৫% এখনও পরিষ্কার হয়নি, যা কাজের গতি ব্যাহত করছে। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মসজিদের পূর্ণ পুনরুদ্ধারে আরও ১৮-২৪ মাস সময় লাগবে।
ইবনে উসমান মসজিদ: অর্থায়নের ঘাটতিতে স্থবিরতা
ইবনে উসমান মসজিদের পুনর্গঠন কার্যক্রম মূলত থমকে আছে অর্থের অভাবে। এর বর্তমান নকশা ডকুমেন্টেশন কাজের ৮৫% সম্পন্ন হলেও বাস্তবায়ন অনেক পিছিয়ে। সংরক্ষিত স্তম্ভের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫টিতে, কিন্তু কাতার সরকারের প্রতিশ্রুত অনুদানের ৬০% এখনও হাতে এসে পৌঁছেনি। ফলে প্রকল্পে নিযুক্ত স্থানীয় কর্মীদের চার মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে।
আল-শামাহ মসজিদ: তুরস্কের সহায়তায় অগ্রগতি
তিনটির মধ্যে সবচেয়ে ভালো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে আল-শামাহ মসজিদে, যেখানে তুরস্কের সরাসরি সহায়তায় ৩ডি স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুনর্নির্মাণ কাজের ৬৫% ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ৮০% অপসারণ করা হয়েছে এবং তুরস্ক অতিরিক্ত ১.৫ মিলিয়ন ডলারের অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য—২০২৬ সালের প্রথমার্ধেই মসজিদটি পুনরায় উদ্বোধন করা।
চ্যালেঞ্জ
১. গাজার অবরোধ: নির্মাণ সামগ্রী ঢোকাতে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করছে।
২. আন্তর্জাতিক অর্থায়ন: মোট প্রতিশ্রুত তহবিলের প্রায় ৪০% এখনও অনাদায়ী।
৩. দক্ষ জনবল সংকট: প্রকল্পের ৫৫% পদ শূন্য রয়েছে।
৪. প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা: স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও ইউনেস্কোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব প্রকল্পে বিলম্ব ঘটাচ্ছে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
গাজার সাধারণ মানুষ এ ধীরগতির কারণে হতাশ। আহমেদ নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘প্রতিদিন আমরা ধ্বংসস্তূপ দেখি, কিন্তু পুনর্নির্মাণ দেখি না।’ ফাতিমা নামের এক শিক্ষিকা জানান, ‘আমাদের শিশুরা এই মসজিদগুলোর ইতিহাস ভুলে যাচ্ছে। আগে তাদের আমরা নিয়ে যেতাম, এখন কেবল ধ্বংসাবশেষই দেখাতে পারি।’
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি—
- একটি আন্তর্জাতিক তদারকি কমিটি গঠন
- মাসিক অগ্রগতি রিপোর্টিং সিস্টেম চালু
- স্থানীয় যুবকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে যুক্ত করা
- ডিজিটাল সংরক্ষণের উদ্যোগকে আরও বিস্তৃত করা
সর্বশেষ পরিসংখ্যান (জুলাই ২০২৫)
- মোট ব্যয় নির্ধারিত: ৯.৮ মিলিয়ন ডলার
- সংগৃহীত তহবিল: ৫.২ মিলিয়ন ডলার
- সম্ভাব্য সময়সীমা: বাকি কাজ শেষ হতে আরও ২-৩ বছর লাগতে পারে
গাজার এই তিনটি ঐতিহাসিক মসজিদ শুধু ইবাদতের স্থান নয়, বরং ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের প্রতীক। বিলম্বিত হলেও এই মসজিদগুলোর পুনর্গঠন অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংহতি, সুপরিকল্পিত তদারকি ও স্থানীয় সম্পৃক্ততার মাধ্যমেই এ কাজ সময়মতো শেষ করা সম্ভব হবে—এই আশা ফিলিস্তিনিদের হৃদয়ে এখনও বেঁচে আছে।
সূত্র: আল-জাজিরা, রয়টার্স, বিবিসি আরবি, দ্য নিউ আরব, আল-কুদস আল-আরাবি, মিডল ইস্ট আই, আনাদোলু এজেন্সি, ডেইলি সাবাহ