গ্যাস্ট্রিক, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ এবং নিত্যব্যবহার্য প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবায়োটিকের দাম গত দুই বছরে কয়েক ধাপে ১৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের লাগাম ছাড়া ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা মানুষ যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিমশিম খাচ্ছে তখন ওষুধের দামে বৃদ্ধি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য। এরইমধ্যে সকল ধরনের ওষুধের দাম আরেক দফা বাড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছেন ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা।
ব্যবসায়ীদের দাবি, ব্যাংক ঋণের সুদ, জ্বালানি খরচ এবং ডলারের চড়া দর ও সংকট রয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে ব্যবসার খরচ বেড়ে গেছে দাবি করে ওষুধের দামের সমন্বয় চাচ্ছেন তারা।
বর্তমানে দেশে ওষুধের বাজার প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার। যার ৯৮ শতাংশের জোগানই আসে দেশীয় কারখানাগুলো থেকে। এছাড়া বাংলাদেশে তৈরি ওষুধ রফতানি হয় প্রায় বিশ্বের অন্তত দেড়শটি দেশে। তবে এই শিল্পের শতকরা ৮০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানি করতে হয়।
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতি বলছে, এই শিল্পের কাঁচামাল আমদানি নির্ভর হওয়ায় ডলারের চড়া দাম ও ঘাটতির কারণে সংকটে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। এছাড়া জ্বালানি সরবরাহ কমে যাওয়ায় পুরোদমে চলছে না কারখানাগুলো। ফলে উৎপাদন ব্যয় ও ব্যবসার খরচ বেড়েছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে আবারও ওষুধের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছেন মালিক সমিতির নেতারা।
যেভাবে আলোচনায় ওষুধের দাম বৃদ্ধি
দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন শিল্প গ্রুপ বেক্সিমকোর মালিক সালমান এফ রহমান। তাকে অভিনন্দন জানাতে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির নেতারা। সেখানেই ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়টি আলোচনায় আসে।
এ বিষয়ে সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল মুক্তাদির গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে ডলারের দাম বেড়ে অফিসিয়ালি ১১০-১১১ টাকা হয়েছে। আগে যা ছিল ৮৬ টাকা। আমরা ওষুধের কাঁচামাল আমদানি করতে ১১৯-১২০ টাকায় ডলার কিনছি। ফলে পর্যায়ক্রমে ওষুধের দর বিন্যস্ত করার চিন্তা করছি।
আবদুল মুক্তাদিরের সাথে সুর মিলিয়ে সালমান এফ রহমান বলেন, আগে ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকা। এখন সেটা ১১০ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই খরচ বেড়ে গেছে। ফলে ওষুধের দাম বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। অন্যথায় ব্যবসায়ীরা লোকসান গুনবে। এভাবে তো ব্যবসা চলতে পারে না।
এছাড়া সময়ের সঙ্গে ওষুধ শিল্পের বিকাশ ঘটলেও স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। এমনকি বছর দশেক আগে এপিআই পার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করে হলেও বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বলে জানান সালমান এফ রহমান।
দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, দাম বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি, তবে নেওয়া হবে। ওষুধের সব কাঁচামাল বিদেশে থেকে আমদানি করতে হয়। এর খরচ ডলারের দামের উপর নির্ভর করে। ৮০-৮৬ টাকার ডলার হয়েছে ১২০ টাকা। এর মধ্যে অনেক ব্যংকই এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলে না। এ ধরনের আরও ঝামেলা রয়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হলে দাম বাড়াতেই হবে। নয়তো ওষুধের ক্রাইসিস তৈরি হবে।
প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার সাথে বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাদের অবস্থা জানতে চেয়েছেন। আমরা আমাদের নানা সমস্যার কথা ওনাকে জানিয়েছি। আমরা বলেছি, আমাদের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, এভাবে চলা কঠিন। তখন তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন। ওষুধের দামের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দেওয়া হবে বলেও জানান ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব।
তবে বর্তমান নিত্যপণ্যের চড়া বাজারে জনগণের অবস্থা বিবেচনায় ওষুধের দাম বাড়ানো কতটা যৌক্তিক এবং এ বিষয়টি কিভাবে এড়ানো যায় তা নিয়ে ভাবার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ।
তিনি বলেন, ওষুধ শিল্প মালিকরা তাদের ব্যবসার বিষয়টি দেখবে। আমাদের ওষুধের কাঁচামাল দেশের বাইরে থেকে আসে। এক্ষেত্রে ডলারের সাথে টাকার দামের তারতম্য হলে তাদের খরচ বেড়ে যায়। ২০১৫ সালের পর গত বছর তারা এক দফা মূল্য বাড়িয়েছে। যেটি অনেক বড় একটি পরিবর্তন ছিল। যেটা তাদের পক্ষ থেকে যৌক্তিক ছিল। বর্তমানে দাম বাড়ানোর যে আলোচনা হচ্ছে, তাদের দিক থেকে এটাও যৌক্তিক বলেই মনে করি। যেহেতু ডলারের দাম বেড়ে গেছে, তাই শিল্পের খরচও বেড়ে গেছে। সেটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তারা দাম বাড়াবে। কিন্তু এই দাবি মেনে ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেওয়া সরকারের জন্য কতটা যৌক্তিক হবে বা কি করণীয় রয়েছে তা দেখার বিষয়। আমি মনে করি সরকারের পক্ষ থেকে এতে সায় দেওয়ার সুযোগ কম।
দাম না বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব
ব্যবসায়ীদের দিক থেকে দাম বাড়ানো যৌক্তিক হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তা ঠিক হবে না জানিয়ে ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু মানুষের উপার্জন তো বাড়ছে না। এ অবস্থায় ওষুধের দাম না বাড়িয়ে অন্য কোনো সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে তাদের সংকট কাটিয়ে দেওয়া যায় কিনা সরকারকে তা দেখতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার কাঁচামাল আমদানির উপর কোনো ট্যাক্স থাকলে তাতে সুবিধা দিতে পারে। তাদেরকে অন্য সুবিধা দিতে পারে যেন তারা খরচ পুষিয়ে নিতে পারে।
মালিকদের নিজেদের উদ্যোগেও ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক আবদুল হামিদ বলেন, মালিক সমিতি যদি সিদ্ধান্ত নেয় তারা এগ্রেসিভ মার্কেটিং করবে না। তারা চিকিৎসকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পেছেন যে অর্থ ব্যয় করে তা যদি কমিয়ে আনবে তাহলেও খরচ অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবে। তবে এ সিদ্ধান্ত সবাই মিলে নিতে হবে। এখান থেকে যদি ১০ শতাংশ খরচ কাট করতে পারে, তাহলেও ডলারের দামের তারতম্যের কারণে বাড়তি খরচের অনেকটা উঠে আসবে। জনগণের কথা চিন্তুা করে সরকার এই আলোকেও তাদের পরামর্শ দিতে পারে। সমিতির উদ্যোগে যদি এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে প্রতিটা প্রতিষ্ঠানই এটি মেনে নিতে বাধ্য হবে।
এছাড়া কাঁচামাল উৎপাদনের জন্য মুন্সিগঞ্জে ইপিআই পার্ক চালুর বিষয়েও উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ এই স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদের।
সুত্র-ঢাকামেইল
সম্পাদক ও প্রকাশক- মেহেদী হাসান
Copyright © 2024 Livenews24. All rights reserved.