সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এক ছবিতে দেখা যায়, ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণ চেয়ারে বসে আছেন। তার চোখ রক্তে লাল, গালের এক পাশ ফোলা। ছবিটির দিকে কোনো ব্যক্তির কয়েক সেকেন্ডের বেশি তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। ছবির ক্যাপশনে লেখা, ‘ছবিটি রোগীর অনুমতি নিয়ে করা। রোগী এক সপ্তাহ আগে দাঁত উঠিয়েছেন। এরপর তার মাড়ি এরকম ফুলে যায়। ডেন্টিস্ট বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) না। আজকে এমবিবিএসকে দেখান। উনি CBC, RBS করতে দেন। Tedibac নামে একটি ট্যাবলেট দেওয়া হয়। রোগীর RBS- ৭.৬৮, Hb% ৮+, WBC- ৫১০০০, Platelet- ১৬, ০০০, প্রেশার ১০০/৫০। পেশেন্টের ভাষ্যমতে, ট্যাবলেট খাওয়ার পর এমন হয়েছে। এ রকম হওয়ার কারণ কী? রোগীর জ্বরের হিস্টি নাই। তবে মনে হচ্ছে সেপটিক শকের দিকে চলে যাচ্ছে।’
পোস্টটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চিকিৎসকদের সব থেকে বড় গ্রুপ ‘প্লাটফর্ম’-এ একজন অ্যানোনিমাস সদস্য করেছিলেন। পোস্টটি কোয়াক ও অপচিকিৎসাসংক্রান্ত হওয়ায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও গ্রুপে তা শেয়ার করা হয়। একইসঙ্গে যেকোনো চিকিৎসাসংক্রান্ত পল্লী চিকিৎসক অথবা কোয়াকের পরামর্শ এবং নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তেমনই একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী রায়হান আহমেদ। তিনি ‘Medivese’ নামক একটি পেজের এই পোস্টটি (প্লাটফর্মের পোস্টের স্কিনশট) শেয়ার করেন। তবে পোস্টটি সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে হলেও তার পোস্টের কমেন্টেই একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ‘প্লাটিলেট অনেক কম তাড়াতাড়ি রক্ত দিতে হবে আগে। হিমোগ্লোবিন ও কম’ বলে মন্তব্য করেন। অথচ মন্তব্যকারী ব্যক্তি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গণিত বিভাগ থেকে গ্রেজুয়েশন সম্পন্ন করা একজন নন-মেডিকেল পার্সন।
প্লাটফর্মের অপর এক পোস্টে ‘ডেলিভারেট সেল্ফ হার্ম’ রোগীর সমস্যা তুলে ধরা হয়। পোস্টটিতে বলা হয়, ‘মেয়েটি বলতেই পারে না সে যে তার হাত কাটছে। ফিনকি দিয়ে রক্তে কিচেন রুম ভরে গেলে মা এসে চিৎকার করে তাকে ডাকেন। সম্বিত ফিরে আসলে রক্ত দেখে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে এলেও কেন সে হাত কাটল, তা বলতে পারে না। তীব্র কোনো মানসিক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে কিংবা কারও সাথে অভিমান করে আত্মহত্যা করতে সে এমন করেছে সেরকমও কিছু নয়। ক্লাসের এক নম্বর মেধাবী ছাত্রী, সকল শিক্ষকের পরম স্নেহের। টেস্ট পরীক্ষা চলছে। কী তার মনের অবস্থা? কী কারণে এমন হতে পারে? মানসিক রোগ সত্যিই রহস্যময়!’
এই পোস্টটির স্কিনশট নিয়েও বিভিন্ন গ্রুপ, পেজ ও ব্যক্তিগত আইডিতে পোস্ট করা হয়। এটার উদ্দেশ্যও সচেতনতা তৈরি। তবে সেখানেও দেখা যায় বিভিন্ন নন-মেডিকেল পার্সনরা নানাবিধ পরামর্শ দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, ‘প্রেমে ছেকা খেয়েছে কি না দেখেন’, ‘কোনো মানসিক সমস্যা না, মেয়েটিকে জ্বিনে ধরেছে’। কেউ কেউ আবার বিভিন্ন ওজা ও ফকিরের নামও উল্লেখ করছেন।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ক এ ধরনের পরামর্শ যেন অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো পরামর্শ দেওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও মানুষ হরহামেশাই নানাবিধ পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। যা করোনাকালে থানকুনি পাতা খাওয়া, ডেঙ্গু রোগীদের পেঁপে পাতা খাওয়ার মতো ভাইরাল টপিকের জন্ম দিয়েছে। যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মেডিকেল শাস্ত্রেও এগুলো প্রমাণিত কোনো চিকিৎসা পদ্ধতি না। তবু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাইরাল এসব বিষয় মানুষ বিশ্বাস করছে এবং তা অনুসরণ করছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে অবাধ ব্যবহার ও সকলে চিকিৎসক বনে যাওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। তাদের পরামর্শগুলো বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত না। যেসব ব্যক্তি এ ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা ওই রোগের বিষয়ে অবগত নন। তারা শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। এগুলো অনুসরণ করলে রোগীর মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ মৃত্যুও হতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পরামর্শ গ্রহণ কাম্য নয়
জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ঢাকা মেইলকে বলেন, এটি একদমই কাম্য নয়। এ ধরনের পরামর্শ গ্রহণ কোনো উপকারে তো আসবেই না বরং তা বিপদের কারণ হতে পারে। যে যা খুশি তা বলে দিল, তাতে তো কিছু হলো না। যেকোনো মানুষ কোনো কিছু বিশ্বাস বা অনুসরণ করার আগে বিষয়টি দেখবেন, পড়বেন ও বুঝবেন। এরপর তারা বিচার-বিবেচনা করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। যে যার মতো একটা কথা বলে দিলেই তো তা চিকিৎসার মাধ্যম হয়ে যায় না। একজন কিছু একটা বলল আর আমরা তার আমল করা শুরু করলাম, এটাতো মানা যায় না। যে বলেছে তার এটা বলার মতো যোগ্যতা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
করোনা মহামারি ও ডেঙ্গুকালে থানকুনি পাতা ও পেঁপে পাতা নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর বিষয়ে তিনি বলেন, মানুষ কেন বিভ্রান্ত হয় তা আমার বুঝে আসে না। একমাত্র বিবেক-বিবেচনাহীন মানুষের পক্ষেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারও পরামর্শ গ্রহণ করা সম্ভব। কারও কোনো বিষয়ে জানার প্রয়োজন হলে তিনি শিক্ষিত ও কোয়ালিফাইড চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। আমাদের দেশে একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত এমবিবিএস চিকিৎসক রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সাধারণ মানুষদের সচেতন হতে হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক- মেহেদী হাসান
Copyright © 2024 Livenews24. All rights reserved.