Friday, March 29, 2024
HomeScrollingতিনি আমাদের একটি জাতিরাষ্ট্র দিয়েছেন, আমাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন

তিনি আমাদের একটি জাতিরাষ্ট্র দিয়েছেন, আমাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন

এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষমুজিববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে। তার এই জন্মদিন বিশেষভাবে উদযাপন করছি আমরা। পুরো দেশ দিনটিতে তাকে স্মরণ করবে। তিনি আমাদের একটি জাতিরাষ্ট্র দিয়েছেন, আমাদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন। তাই তার এই জন্মদিন উদযাপন করার মধ্য দিয়ে আমরা তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করার একটি সুযোগ পাচ্ছি। আমাদের দেশকে স্বাধীন করতে তার যে কষ্টকর প্রচেষ্টা, সেটা শুরু হয়েছিল একেবারে ভাষা আন্দোলন থেকে। তিনি শুরু থেকেই একজন মাটির মানুষ, শেকড় থেকে তিনি জননেতায় পরিণত হয়েছিলেন। জননেতা থেকে তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে একটি রাষ্ট্রের একক নেতায় পরিণত করেছিলেন। একটি জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। তাকে আমরা জাতির জনক বলে অভিহিত করেছি।

আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথকে তার বাবা ছোটবেলায় হিমালয়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, যাতে তিনি বড় মনের অধিকারী হতে পারেন, প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে পারেন এই চিন্তা থেকে। বঙ্গবন্ধুও তেমন প্রকৃতির সন্তান ছিলেন। তিনি জেলখানায় বসে বলেছেন, এখন যদি আমি আমার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে পারতাম! এই যে একটি শিশুসুলভ মানুষকে আমরা দেখি এটাই আসল বঙ্গবন্ধু। তার মনের কথা এবং মুখের কথা একই ছিল। তিনি বলেছেন, দেশের জন্য প্রাণ দেব। দেশের মানুষের জন্য তো আমরা রক্ত দিয়েছি। প্রয়োজনে আরও দেব রক্ত। তখন আমরা বুঝতে পারি, তিনি সত্যিকার অর্থেই কথাগুলো বলেছেন।

গণতন্ত্রের কথা মানেই হচ্ছে দেশ, দেশের মাটি ও মানুষের কথা বলা। বঙ্গবন্ধু সবসময় সেটাই ছিলেন। তিনি ছিলেন মাটির কাছাকাছি। জনমানুষের মনের কথাই তিনি বলতেন। মানুষের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষাই তার বক্তব্যে পাওয়া যেত। এদিক দিয়ে তিনি বিশ্বের অন্যান্য নেতাদের থেকেও ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিংয়ের বক্তব্যও তাৎক্ষণিক ছিল না। কিন্তু আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তব্য তাৎক্ষণিক ছিল। আমরা যদি ১৯৪৭-এ জওয়াহেরলাল নেহরুর বক্তব্যর দিকে তাকাই সেটিকে এর কাছাকাছি বলতে পারি, তাৎক্ষণিক বক্তব্য বলে ধরতে পারি। ’৪৭-এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হলো। একটি হলো পাকিস্তান, অপরটি ভারত। আমরা রইলাম পাকিস্তানে। সে সময়ে ভারতের নেতা নেহরু যেভাবে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার বক্তব্য স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। সেইদিন তিনি সুস্থ ছিলেন না। এটি আমরা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অনেকবার শুনেছি। তিনি বলেছেন, আব্বার শরীরটা ভালো ছিল না। আমি তার মাথা টিপে দিচ্ছিলাম। রেসকোর্সে যাওয়ার আগে মা আব্বাকে বললেন, আপনি কারও কথা শুনবেন না। আপনার মনে যা আসে, আপনি কেবল সেই কথাই বলবেন। পরে আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধু তার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। যার সঙ্গে কোনো ভাষণের তুলনা চলে না। তার সেদিনের বক্তব্য জুলিয়াস সিজারের বক্তব্যের মতো রক্তঝরানো বক্তব্যই কেবল ছিল না, সেটি ছিল একইসঙ্গে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনামূলক  বক্তব্য। একজন রাষ্ট্রনেতার মতো বক্তব্য দিয়েছিলেন তিনি। একটি বক্তব্য দিয়ে তিনি ত্রিশ লাখ লোককে জীবন দিয়ে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দুই লাখ মা-বোনকে নির্যাতিত হতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। তার বক্তব্যটিই ছিল বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে নিয়ে যাওয়া চূড়ান্ত প্রেরণামূলক বক্তব্য।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসম্ভব সাহসী। ২৫ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল ফাঁসিকাষ্ঠের কাছে। তাকে মৃত্যুর ভয় দেখানো হয়েছিল। দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বললেন, তার জন্য কবর খনন করে তাকে দেখানো হয়েছিল। তবুও তিনি পাকিস্তানিদের সঙ্গে আপস করেননি। এদিকে তারই বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশে চলছে মুক্তিসংগ্রাম। আর তাকে রাখা হয়েছে দূর দেশে কারবন্দি করে। অবশেষে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে দেশ স্বাধীন হলো।

স্বাধীনতার পরেও প্রিয় নেতাকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানিরা গড়িমসি করল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে ওঠে। পরে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের প্রায় একমাস পরে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ তাকে বিশ্বজনমতের চাপে মুক্তি দেওয়া হলো। প্রথমে তিনি বিলেত গেলেন। সেখান থেকে ভারত হয়ে দিশে ফিরলেন। তার ফেরার সময়ে ভুট্টো বলেছিলেন রাতের পাখি উড়ে গেছে। অর্থাৎ বোঝানো হয়েছে যে, রাতের পাখিকে কেউ আটকাতে পারে না।

বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমেই কেঁদে ফেললেন। মানুষের উচ্ছ্বাস, ভালোবাসা ও অশ্রুসিক্ত সংবর্ধনার পরেই তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে উচ্চারণ করলেন ‘নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!’।

রবীন্দ্রনাথ তার ঠোঁটস্থ ছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা তিনি সময় পেলেই পাঠ করতেন। বঙ্গবন্ধু জীবনের অনেকটা অংশ জেলখানায় কাটিয়েছেন। তিনি এই সময়ে প্রচুর বই পড়েছেন। তার লেখা কারাগারের রোজনামচা বইটি পড়লেই আমরা এসব বিষয়ে ধারণা পাই। জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকার সময়ে তিনি ৩টি বই লিখেছেন। তার এসব বই পড়লে আমরা সহজেই বুঝতে পারি তিনি লেখক হিসেবেও অনেক উঁচু মানের লেখক। তার ৩টি বই জুড়েই দেশ, দেশের মানুষের মুক্তির কথা লেখা রয়েছে। দেশভাবনা জানতে পারি তার লেখার মধ্য দিয়ে।

তিনি ছিলেন শৃঙ্খলিত মানুষের মুক্তির দূত। দেশ স্বাধীনের পরে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন তিনি। এই তিন বছরেই একটি সদ্য স্বাধীন দেশ গড়তে তিনি মনোনিবেশ করলেন। তিনি পুরো দেশকে নিজের পরিবারের মতো করে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি লক্ষাধিক মানুষকে চিনতেন। কারও সঙ্গে দেখা হলেই নাম ধরে ডাকতেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ভালো। তার সঙ্গে আমারও দেখা হয়েছিল। কাছ থেকে তাকে দেখার সুযোগ হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর মনপ্রাণ জুড়ে ছিল বাঙালি ও বাংলাদেশ। তাকে মনে না করে আমাদের কোনো উপায় নেই। দেশের প্রতিটি মানুষের মাঝেই তিনি আছেন, থাকবেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের গুণাবলি পেয়েছেন তারই তনয়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই করোনা মহামারীর সময়েও তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। আমরা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করতে পারছি। ঢাকায় মেট্রোরেল হচ্ছে। ভবিষ্যতে পাতাল রেল, টানেলসহ আরও উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা আমরা জানতে পারছি। এই সময়ে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ মুজিববর্ষ উদযাপন করতে পারা আমাদের মতো বয়সের লোকেদের জন্য সত্যি আনন্দের এবং সৌভাগ্যের। দেশের স্বাধীনতা দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর ৫০ বছর পূর্তি দেখেছি। এখন আবার স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করতে পারছি এটা পরম সৌভাগ্যের।

বঙ্গবন্ধু কখনো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন না। পুরাণের মৃত্যুঞ্জয়ী ফিনিক্স পাখির মতো তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন। বারবার তিনি ফিরে আসবেন। তখন শেক্সপিয়র থেকে আগামীর প্রজন্মে উদ্দেশে তিনি বলবেন ‘মানুষ কত সুন্দর হয়; হে সাহসী বিশ্ব!’

লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।

বঙ্গবন্ধু কখনো আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবেন না। পুরাণের মৃত্যুঞ্জয়ী ফিনিক্স পাখির মতো তিনি আমাদের মাঝে থাকবেন। বারবার তিনি ফিরে আসবেন। তখন শেক্সপিয়র থেকে আগামীর প্রজন্মে উদ্দেশে তিনি বলবেন ‘মানুষ কত সুন্দর হয়; হে সাহসী বিশ্ব!’

 

সুত্র- দেশরূপান্তর

RELATED ARTICLES
Continue to the category

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments