দেশে ‘চোখ ওঠা’ রোগ বেড়ে গেছে। অন্য বছরের এ সময়ের তুলনায় এবার রোগী কিছুটা বেশি। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী বেড়ে গেছে। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো পরিবারের সব সদস্যই আক্রান্ত হয়েছেন।
এমন অবস্থায় রোগীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলেছেন, সাধারণত ৩-৫ দিনেই মধ্যেই চোখ ওঠা রোগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে এই সময়ের মধ্যে ভালো না হলে তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। যারা চাকরি করে ও যেসব বাচ্চা স্কুলে যায়, তাদের চোখ ওঠা রোগ হলে অবশ্যই ছুটি নিতে হবে। কারণ এটা সংক্রামক ব্যাধি।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা গতকাল শনিবার বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এখন যত রোগী, তাদের মধ্যে ১৫-২০ শতাংশ চোখ ওঠা রোগী দেখা যাচ্ছে। অন্য বছরের তুলনায় এবার একটু বেশিই মনে হচ্ছে। এটা সিজনাল ডিজিজ। সাধারণত এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। তবে বেশি হলে চিকিৎসা লাগে। অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ও চোখে ড্রপ দিলে ভালো হয়ে যায়।’
একই হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাগ বলেন, ‘চোখ ওঠা রোগ একদম বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই আমরা চেম্বারে রোগী পাচ্ছি। হাসপাতালেও রোগীদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকের চেম্বারে আমরা প্রতিদিন ৪-৫ জন করে রোগী পাচ্ছি। চোখ লাল, চোখ ফুলে গেছে, চোখে আরাম পাচ্ছে না, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, চুলকাচ্ছে এরকম উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসছে। আমরা ধারণা করছি, এগুলো ভাইরাল ইনফেকশন (ভাইরাসজনিত সংক্রমণ)। সম্ভবত এডিনো ভাইরাস সংক্রমণের মূল কারণ।’
এবার কিছুটা ব্যতিক্রম: চোখ ওঠা রোগ সাধারণত এক ধরনের ভাইরাসজনিত ছোঁয়াচে রোগ। এডিন নামক এক ধরনের ভাইরাস এই রোগের মূল কারণ। তবে এবার ধরন দেখে চিকিৎসকরা কিছুটা ব্যতিক্রম বলে মনে করছেন। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, সাধারণত চোখ ওঠা রোগ এক ধরনের ভাইরাসের দ্বারা হয়। তবে এবার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এবারেরটা ব্যাকটেরিয়াজনিত। কারণ এবারের রোগীদের চোখে পিচুটি হচ্ছে। ভাইরাসের দ্বারা হলে পিচুটি হয় না। ভাইরাসজনিত চোখ ওঠাটাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যাকটেরিয়াজনিত চোখ ওঠা অতটা ঝুঁকিপূর্ণ না।
কালো চশমায় সংক্রমণ কম ছড়ায়: এই দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আক্রান্তদের কালো চশমা পরার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন, সম্ভব হলে একটা কালো সানগ্লাস ব্যবহার করা যেতে পারে, যাতে চোখের জীবাণু অন্য জায়গায় ছড়িয়ে না পড়ে। এতে ভাইরাস ছড়াবে কম। কালো চশমা পরলে ভালো। কারণ আক্রান্ত ব্যক্তির চোখে রোদ বা আলো পড়লে চোখে অস্বস্তি লাগে।
প্রথম ৩-৫ দিন খুবই সতর্ক থাকতে হবে: অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাগ বলেন, চোখ ওঠার ৩-৫ দিন রোগীদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে। যেমন চোখে হাত দিয়ে কচলানো যাবে না। কারণ হাত দিয়ে কচলানোর পর ওই হাত দিয়ে যা ধরবে, সেটার মাধ্যমে অন্যরা সংক্রমিত হবে। চোখ চুলকালে সুতির কাপড়ের ছোট ছোট টুকরো ব্যবহার করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাড়ির অন্যদের থেকে একটু দূরত্ব রক্ষা করে চলতে হবে। কাপড়চোপড় অন্যদের কাপড়চোপড় থেকে আলাদা রাখতে হবে। চোখ যাদের ওঠে, তাদের সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করতে হবে।
এ ব্যাপারে আরও পরামর্শ দিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, চোখ যদি ওঠে, সাধারণত ভাইরাল ইনফেকশন এমনিই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু কোনো সময় যদি চোখে অস্বস্তি দেখা দেয়, যেমন- চোখ লাল হয়ে যায়, পানি পড়ে, চুলকানো হয়, তখন আমরা রোগীদের ওষুধ দিই। চুলকালে অ্যান্টি এলার্জিক, যেমনফেক্সো ফেনাডিন জাতীয় ওষুধ দেই, লাল হলে একধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দিই, কোনো সময় চোখে অস্বস্তি হলে লুব্রিকেন্ট জাতীয় আর্টিফিশিয়াল ক্লিয়ার ওষুধ দিই।
এই চিকিৎসকের মতে, যদি দেখা যায় তিন-চার দিনের মধ্যেও চোখ ওঠা ভালো হচ্ছে না, তা হলে তাকে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ সাধারণ চোখ ওঠা রোগে চোখের সাদা অংশ সংক্রমিত হয়। কিন্তু কোনো কোনো সময় চোখের ভেতরের সাদা অংশ থেকে কালো অংশ অর্থাৎ কর্নিয়াও সংক্রমিত হতে পারে। সেইক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও দরকার হতে পারে। এ জন্য যাদের ৩-৫ দিনের মধ্যে চোখ ওঠা ভালো হয় না, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই চোখের চিকিৎসক দেখাতে হবে। কারণ দেখতে হবে তার চোখের ভেতর ভাইরাস ঢুকে কর্নিয়া বা তারও ভেতর সংক্রমিত করছে কি না।
চোখ উঠলে ছুটি নিতে হবে: অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাগ বলেন, বিশেষ করে, যারা চাকরি করে ও যেসব বাচ্চা স্কুলে যায়, তাদের চোখ ওঠা রোগ হলে অবশ্যই ছুটি নিতে হবে। কারণ এটা সংক্রামক ব্যাধি। চোখ ওঠা নিয়ে কেউ অফিসে গেলে বা বাচ্চারা স্কুলে গেলে তার থেকে অফিসের অন্য সহকর্মী ও স্কুলের অন্য বাচ্চারা আক্রান্ত হবে। এটা কাম্য নয়। কারণ এখন চোখ ওঠা রোগ খুবই বেড়ে গেছে।
অন্য বছরের তুলনায় এবার কিছুটা বেশি: এই দুই চিকিৎসক জানিয়েছেন, সাধারণত এই সময়েই এই রোগটা বেশি হয়। শীত আসছে। আবার গরমও আছে। এমন আবহাওয়ায় ভাইরাল, ব্যাকটেরিয়াল ও ফাঙ্গাল জাতীয় রোগ বেশি হয়। এসব রোগের উপদ্রুব বেড়ে যায়। এখন ভেজা গরম। সিজনাল ব্যাপার আছে। তবে বেশি ছড়ায় অসচেতনতা থেকে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ডা. দীপক কুমার নাগ বলেন, আমার চেম্বারে রোগী আসে। সঙ্গে আরও দুই-তিনজন থাকে। তারা ওই রোগীর সঙ্গে একদম গায়ে গায়ে লেগে আছে। এই রোগী নিশ্চয় বাইরে বসে ছিল। তার সঙ্গে অন্যরাও বসেছিল। তাই সচেতনতার অভাবে এটা আরও বেশি পরিমাণ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
অন্য বছরের তুলনায় এ রোগ এবার একটু বেশি মনে হচ্ছেজানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, সংক্রমণ মাত্রা অনেক বেশি। অন্য বছর এই সময়ে আমরা এত বেশি রোগী দেখিনি। গতকাল রাত (গত শুক্রবার) থেকে এখন পর্যন্ত (গতকাল শনিবার সন্ধ্যা) তিন-চারটা পরিবার থেকে টেলিফোন করেছে। তাদের মধ্যে একটি পরিবারের সবাই আক্রান্ত। অন্য পরিবারেরও বেশিরভাগই আক্রান্ত।
রোগীদের প্রতি পরামর্শ: অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বলেন, রোগীদের প্রতি আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, এটা যেহেতু ছোঁয়াচে রোগ, তাই যার হয়েছে, তিনি চোখে হাত দেওয়ার পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেললে তার মাধ্যমে অন্যরা আক্রান্ত হবে না। কারণ আক্রান্তরা যদি কোনো জায়গায় হাত দেয়, সেই জায়গায় অন্যরা হাত দিলে বা স্পর্শ করলে তারাও আক্রান্ত হবে। আমরা প্রতিদিন রোগী দেখছি। আমাদের হচ্ছে না। কারণ আমরা সতর্ক আছি। রোগী দেখি, হাত ধুয়ে ফেলি। রোগীও যদি বাসায় সতর্ক থাকে, তার বাসায় অন্যদের হবে না।
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আরও বলেন, যেসব রোগী বাসায় আছেন, তাদের ব্যবহৃত রুমাল, গামছা, কাপড়চোপড় অন্যরা যাতে ব্যবহার না করে, সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
সুত্র- দেশরুপান্তর, প্রতীক ইজাজ